নাসরীন সুলতানা।।
কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিষয় নিয়ে খুব ট্রল বা ঠাট্টা–বিদ্রুপ হতে দেখি। এবারের বিপিএলের ফাইনাল খেলায় একজন ক্রীড়া প্রতিবেদক এক বিদেশি খেলোয়াড়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ভুলভাল ইংরেজিতে প্রশ্ন করছেন। এ কারণে ওই খেলোয়াড় বুঝতেই পারছিলেন না তাঁকে কী প্রশ্ন করা হচ্ছে। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, ‘যিনি ঠিকমতো ইংরেজি কথা বলতে পারেন না, তাঁকে কেন ম্যাচ প্রতিবেদন করতে পাঠানো হলো?’ যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়া কেন বিদেশি খেলোয়াড়দের প্রশ্ন করা হলো, সে অভিযোগও উঠে এসেছে।
প্রশ্ন হলো, এই যে আমাদের একজন সাংবাদিক ইংরেজিতে প্রশ্ন করতে পারছেন না, এর দায় কার? সাংবাদিকের নিজের? সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের? অবশ্যই তাদের দায় আছে। তবে মূল গলদ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। কারণ স্কুল-কলেজে ১২ বছর ধরে ইংরেজি পড়ার পর আমরা ইংরেজি শিখতে বা ইংরেজিতে কথা বলা রপ্ত করতে পারি না। ফলে কর্মজীবনে গিয়ে পিছিয়ে পড়তে হয় এবং ওই ক্রীড়া প্রতিবেদকের মতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
ভাষাদর্শনের একজন গবেষক হিসেবে আমি যত দূর জানি, একটি ভাষার মূলত চারটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ: সিনট্যাক্স, শব্দভান্ডার, সিম্যানটিকস ও প্রাগমেটিকস।
একটি ভাষা আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে সেই ভাষার শব্দভান্ডারে যত বেশি আয়ত্ত থাকবে, তত বেশি সেই ভাষার ওপর দখল থাকবে। সিনট্যাক্স হলো একটি ভাষার শব্দগুলো যে নিয়ম অনুসরণ করে একটির সঙ্গে অন্যটি পাশাপাশি বসে একটি অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরি করে, সে-সম্পর্কিত নিয়ম। প্রতিটি ভাষার শব্দগুলোর নিজস্ব একটি অর্থ আছে। এই অর্থ হলো ওই শব্দের সিম্যানটিকস। আবার কোনো একটি শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে বক্তা কী বোঝাতে চেয়েছে, সেটি হলো ওই শব্দ বা বাক্যের প্রাগমেটিকস। মূল কথা হলো, কোনো ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হলে সেই ভাষার শব্দভান্ডার, বাক্যের গঠন এবং তার ব্যবহার খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আয়ত্ত করার কাজ আমরা করব কীভাবে?
দার্শনিক জন সার্ল তাঁর ‘স্পিচ অ্যাক্ট’ গ্রন্থে নির্দেশনামূলক বিধি (রেগুলেটিভ রুলস) ও গঠনমূলক বিধির (কনস্টিটিউটিভ রুল) মধ্যে পার্থক্য করেন। দাবা খেলার যে নিয়ম, সেটি গঠনমূলক বিধি বা কনস্টিটিউটিভ রুল। এ নিয়ম ছাড়া দাবা খেলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভাষার যে নিয়ম বা বিধি, সেটি হলো রেগুলেটিভ বিধি। অর্থাৎ, একটি শিশু যখন ভাষা শেখে, তখন সে তার ব্যাকরণগত নিয়ম না জেনেই সেটা শেখে।
শিশু প্রথমে কথা শোনে এবং পরে কথা বলার মাধ্যমে ছোট ছোট শব্দ এবং পরে একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে একটি ভাষা রপ্ত করে। এরপর তাকে প্রথমে পড়া এবং সব শেষে লেখা শেখানো হয়। এটাই মূলত ভাষা শেখার সহজ এবং প্রাকৃতিক নিয়ম। আমরা যখন বাংলা শিখেছি, আমরাও এভাবেই বাংলা ভাষা রপ্ত করেছি। প্রথমে শুনেছি, তারপর বলেছি, একটু বড় হয়ে অক্ষর চিনেছি এবং পড়তে শিখেছি এবং সব শেষে লিখতে শিখেছি।
বাংলাদেশের কারিকুলামে ১২ বছর ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে পড়া ও লেখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং পরীক্ষাপদ্ধতিতে শোনা ও বলার বিষয়টি কখনোই বিবেচিত হয়নি। অর্থাৎ, একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে কি না, সে পরীক্ষা দিতে হয় না, নেটিভদের ইংলিশ শুনে সে বুঝতে পারে কি না, সে পরীক্ষা তাকে কখনোই দিতে হয় না। ফলে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর এ দুদিকে দক্ষতার মাত্রা একেবারে শূন্যের কাছাকাছি।
অন্যদিকে, ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে আমাদের শিখনপদ্ধতিতে আমরা উল্টো পদ্ধতি প্রয়োগ করি। আমরা প্রথমে অক্ষর চিনি এবং পড়তে শিখি, এরপর লিখতে শিখি। শোনা ও বলার অনুশীলন আমরা একেবারে করি না বললেই চলে। এমনকি শিক্ষকেরাও ইংরেজি পড়ানোর সময় বাংলায় কথা বলেন, কারণ তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও পড়া ও লেখার পাঠ ঠিকমতো হলেও শোনা ও বলার পাঠ অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। ফলে কয়েক দশকেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজির ব্যবহার কেবল লেখা ও পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে; শিক্ষার্থীরা বলার ও শোনার ক্ষেত্রে সক্ষমতা ততটা অর্জন করতে পারেনি।
কোনো ভাষায় দখল কিংবা দক্ষতার মানদণ্ড মূলত চারটি—শোনা, বলা, পড়া ও লেখা। এ চার বিষয়ে কে কতটা সফল, তার ওপর নির্ভর করে সে সেই ভাষায় কতটা পারদর্শী। এমনকি আইইএলটিএসের মতো ভাষার দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষাগুলোতেও আমরা দেখি, এ চার বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। ফলে, ইংরেজিকে ভাষা হিসেবে আয়ত্ত করতে হলে এ চার বিষয়ের ওপরই সমান গুরুত্ব দিতে হবে এবং শিক্ষাক্রম ও পরীক্ষাপদ্ধতিতে এ চার বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশের কারিকুলামে ১২ বছর ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে পড়া ও লেখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং পরীক্ষাপদ্ধতিতে শোনা ও বলার বিষয়টি কখনোই বিবেচিত হয়নি। অর্থাৎ, একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে কি না, সে পরীক্ষা দিতে হয় না, নেটিভদের ইংলিশ শুনে সে বুঝতে পারে কি না, সে পরীক্ষা তাকে কখনোই দিতে হয় না। ফলে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর এ দুদিকে দক্ষতার মাত্রা একেবারে শূন্যের কাছাকাছি।
আমার মেয়ে কানাডার একটা স্কুলে গ্রেড ৫-এ পড়াশোনা করছে। তাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ফ্রেঞ্চ শিখতে হচ্ছে। সে ইতিমধ্যে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলতে শিখেছে। মাত্র এক বছরে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাষায় কথা বলার সক্ষমতা দেখে আমি অবাক হয়েছি। আমি কৌতূহলবশত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম স্কুলে সে কীভাবে ফ্রেঞ্চ শেখে। সে আমাকে বলল, প্রতিদিন ফ্রেঞ্চ ক্লাসে তার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ফ্রেঞ্চে কথা বলে। প্রথমে তাদের ছোট ছোট শব্দ শেখানো হয়েছে। তাদের বিভিন্ন বস্তু, যেমন ফুল, পাখি, দিন, মাস, আবহাওয়া, আসবাবপত্র ইত্যাদির নাম শেখানো হয়েছে। তারপর একটি সম্পূর্ণ বাক্য বলা শেখানো হয়েছে। এরপর শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে প্রতিদিন একজন করে শিক্ষার্থীকে দিয়ে ক্লাস পরিচালনা করানোর মাধ্যমে ফ্রেঞ্চ শেখানো হয়েছে। অর্থাৎ, একজন শিক্ষার্থী প্রশ্ন করবে আর বাকি শিক্ষার্থীরা সেটার উত্তর দেবে। সম্পূর্ণ এ কথোপকথন হবে ফ্রেঞ্চে। অর্থাৎ, তাদের প্রাকৃতিক উপায়ে ভাষা শেখানো হচ্ছে। তার রিপোর্ট কার্ডেও শোনা, বলা, পড়া ও লেখা—এ চার বিষয়ে তার পারদর্শিতার বিষয়টি আলাদা আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
একটি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হলো অপরপক্ষ কী বলল, সেটি বোঝা এবং তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারা। অর্থাৎ, কমিউনিকেশন স্থাপন করা। আমরা যেহেতু শোনা ও বলার অনুশীলন কম করি, তাই আমাদের কমিউনিকেশনের দক্ষতা তলানিতে। পক্ষান্তরে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের শিক্ষার্থীরা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ভারতের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র ও টিভি অভিনেতারা ইংরেজিতে অনেক পারদর্শী। কারণ তাঁদের শিক্ষাব্যবস্থাই বিষয়টি তৈরি করে দেয়।
আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় ‘মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন’ ইংরেজিতে করার মতো সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। তবে অন্তত ইংরেজি বিষয়ের ক্লাসে যাতে মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন অন্তত ইংরেজিতে হয়, সেদিকে আমাদের নজর দেওয়া জরুরি। আর সে জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী বা বিশেষায়িত জ্ঞান আছে—এমন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।সুত্র প্রথম আলো
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৩/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়