সাত কলেজের সমস্যা আর কতকাল

মিজান শাজাহানঃ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে কেন? শ্রেণিকক্ষ, পড়ার টেবিল ছেড়ে এসব শিক্ষার্থী বারবার রাস্তায় নামছেন; স্লোগান তুলছেন; আন্দোলন করছেন– তাদের কষ্ট কি কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করতে পারছে না? নাকি তারা জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে?

সিজিপিএ শর্ত শিথিল করে অকৃতকার্যদের মানোন্নয়ন পরীক্ষা নিয়ে পরবর্তী বর্ষে উত্তীর্ণের সুযোগ দাবিতে সম্প্রতি নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে সাত কলেজের সমন্বয়ক ও ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করেছেন। অধ্যক্ষের আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারেননি আন্দোলনকারীরা। আশ্বস্ত হতে না পারার সহজ কারণ– ঢাবি উপাচার্য ছাড়া এসব সমস্যার সমাধান হবে না। শিক্ষার্থীরা যেমন বারবার রাস্তায় নেমেছেন, তেমনি নীতিনির্ধারকরাও বারবার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু ফয়সালা রাজপথেও হয়নি, আলোচনার টেবিলেও না।

ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ– এ সাতটি কলেজ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। গত ৬ বছরে এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছেন, সড়ক অবরোধ করেছেন। মাঝেমধ্যে পুলিশের ডান্ডার বাড়ি হজম করেছেন। সড়ক অবরোধ করে রাখলে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়; যানজটে নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে। তাই পুলিশ ‘হালকা’ লাঠিচার্জ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। জনস্বার্থে নাগরিক জীবন স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করে। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ ছাড়া পুলিশের কাছে শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধানও নেই। সমাধান যাদের হাতে অর্থাৎ সাত কলেজের শিক্ষকদের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, একাডেমিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজ কর্তৃপক্ষ; তারা কেন সমাধান দিতে পারছে না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি শিক্ষার্থী হতে পারেননি তারা। তাই যখন তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়; দু’চোখে ছিল নতুন স্বপ্ন– একদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের অভিশাপ থেকে মুক্তি; অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক-স্নাতকোত্তর সনদ ঝুলিতে যুক্ত হওয়া। কিন্তু সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপ নিতে বেশি সময় লাগেনি।

সাত কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করার সময় শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এখন অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, আগেই ভালো ছিলাম। ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলাও। তখন নীতিনির্ধারকরাও কম উৎসাহ দেখাননি। সেই উৎসাহীরা এখন কেন চুপ করে আছেন? যেসব সীমাবদ্ধতার কারণে সমাধান দিতে পারছেন না, তখন কি এসব মাথায় ছিল না? ভাগ্য ভালো, একই সময়ে দেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সব কলেজ অধিভুক্ত করা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাত কলেজের ব্যাপারে যেভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তা অন্যরা দিলে পরিস্থিতি আরও বেগতিক হতে পারত।

আমরা কথায় কথায় ’৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের কথা বলি। বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলি-লিখি। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে এত শিক্ষা কমিশন হলো, কিন্তু এ খাতে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা আনা গেল না। গলদ কোথায়?

শিক্ষার্থীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে ক্ষতি সবার। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফল ৬০ দিনের মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ সাত কলেজের ফল প্রকাশে ৮-৯ মাস লেগে যায়। এ সময়ে শিক্ষার্থীরা পরবর্তী বর্ষে ক্লাস করেন; ইনকোর্স ও টেস্ট পরীক্ষায়ও অংশ নেন। ফল প্রকাশের পর দেখা যায়– অকৃতকার্য। এভাবে ৮-৯ মাস ক্লাস শেষে আগের বর্ষে ফিরে যাওয়া আদৌ সুখকর নয়। সব বর্ষের শিক্ষার্থীই এ অনিয়মের ভুক্তভোগী। জনবল ও কারিগরি সংকট দূর না করে সাতটি কলেজের দেড় লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে বিড়ম্বনায় ফেলার দায় কে নেবে? উৎসাহ ভালো। কিন্তু অতিউৎসাহ বিপদ ডেকে আনে। জি হুজুর, তেলবাজি আরও বিপজ্জনক।

সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক আছেন চারজন। এর বাইরে অতিথি শিক্ষক একজন। বিভাগে প্রতিবছর ভর্তি হন ১৭০ জন। এর পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতেও প্রতিবছর ভর্তি হয় কয়েকশ শিক্ষার্থী। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে এখন শিক্ষক আছেন ৩৩ জন। ঢাবিতে এই বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে প্রতিবছর ভর্তির সুযোগ পান ১৫০ জন। শিক্ষক সংকট শুধু সোহরাওয়ার্দী কলেজেই নয়; বাকি ছয়টিরও অবস্থা কমবেশি একই।

মেঘে মেঘে বেলা অনেক গড়িয়েছে। এবার সমাধানের পালা। আর যেন শিক্ষার্থীদের রাজপথে নেমে স্লোগান তুলতে না হয়। এ জন্য সমাধানের পথ বের করার সময় এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পরীক্ষার ফল প্রকাশে ৬০ দিনের বেশি সময় কেন লাগছে, তা চিহ্নিত করার সময় বয়ে যাচ্ছে। যে সদিচ্ছা নিয়ে সাতটি কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হয়েছিল, তার পূর্ণতায় প্রতিবন্ধকতার কাঁটা উপড়ে ফেলার বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বেলায় যে আচরণ করছে, সাত কলেজের বেলায় তার ব্যত্যয় কাম্য নয়। মায়ের কাছে যেমন এক সন্তান কোলের, আরেক সন্তান কাঁধের হয় না। তেমনি ঢাবিকেও নিরপেক্ষ আচরণ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতা থাকলে খোলামেলা বলে দেওয়া উচিত। মন রক্ষার জন্য আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিষয়টি জটিল করা উচিত নয়। ভার সইতে না পারলে ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো কোনো শিক্ষার্থীর মন্তব্য দেখে মনে হয়, তারা বলতে চাচ্ছেন– ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। এ অবস্থায় মা যদি বলে, ছাড়বও না, মরতেও দেব না। তাহলে দু’কূল রক্ষা হবে, এটি সত্য। সবচেয়ে বড় সত্য, সাত কলেজের প্রতি নতুন শিক্ষার্থীরা অনুৎসাহিত হবে। এটি আমাদের কারও কাম্য নয়।

সাত কলেজ কর্তৃপক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন সমাধান দিতে পারছে না তখন সমাধান কোথায়? প্রধানমন্ত্রী সুদৃষ্টি দিলে সমাধান অতি কম সময়ের ব্যাপার– এ ধারণার বাস্তবতা নানা ক্ষেত্রে প্রমাণিত।

লেখকঃ সাংবাদিক

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৬/০৮/২০২৩   

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়