শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডি প্রবিধানমালায় তাদের ১৬টি দায়িত্বের কথা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোথাও তাদের সম্মানী গ্রহণ বা তাদের পেছনে অন্যান্য ব্যয়ের কথা বলা হয়নি। কিন্তু আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিলের গভর্নিং বডি (জিবি) শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির পাশাপাশি বড় ধরনের সম্মানী গ্রহণ নানা ব্যয়ে সিদ্ধহস্ত।
গত ৯ বছরে জিবির ১৩ জন সদস্য সম্মানী নিয়েছেন ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৬ টাকা, তাদের আপ্যায়নে খরচ হয়েছে ১৩ লাখ ৪০ হাজার ২৮৬ টাকা এবং জিবির পেছনে আনুষঙ্গিক ব্যয় হয়েছে ৩১ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭৬ টাকা। আর এই গভর্নিং বডি নির্বাচনের পেছনে ব্যয় হয়েছে ৩৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫২ টাকা। সব মিলিয়ে এই অঙ্ক ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার মতো। শুধু কি তা-ই, টিউশন ফির টাকায় গভর্নিং বডির সদস্যরা ব্লেজারও কিনেছেন। তারা প্রতিটি ব্লেজার কিনেছেন ৪১ হাজার টাকা করে। এ জন্য ১৩ জন সদস্য নিয়েছেন ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৮২ টাকা।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক তদন্ত প্রতিবেদনে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিলের চারটি শাখায় এসব অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে আসে। ডিআইএ তাদের প্রতিবেদনে ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের তথ্য তুলে ধরে।
ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্থিক বিধিতে প্রভিশন না থাকা সত্ত্বেও স্কুলটির প্রতিটি শাখা থেকে গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যরা সম্মানী নিয়েছেন। এর মধ্যে মতিঝিল বাংলা ভার্সন থেকে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৬০০ টাকা, মতিঝিল ইংরেজি ভার্সন থেকে ৫ লাখ ৫৭ হাজার ১০০, মতিঝিল কলেজ শাখা থেকে ১০ লাখ ২০ হাজার ৮৩৯, বনশ্রী বাংলা ভার্সন থেকে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ২০০, বনশ্রী ইংরেজি ভার্সন থেকে ২ লাখ ৪৮ হাজার এবং মুগদা বাংলা ভার্সন থেকে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৭ টাকা। আর জিবির পেছনে মতিঝিল শাখা আনুষঙ্গিক ব্যয় করেছে ১৬ লাখ ৩১ হাজার ১৭৮ টাকা, বনশ্রী শাখা ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ৮০৮ টাকা এবং মুগদা শাখা ৪৬ হাজার ৯৯০ টাকা।
তবে সেখানেই থেমে থাকেনি গভর্নিং বডি। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল তারা সম্মানী হার পুনর্নির্ধারণ করেন। তাতে সভাপতির জন্য সম্মানী রাখা হয় ২৫ হাজার টাকা, প্রত্যেক সদস্য ৬ হাজার টাকা, সভার কাজে সহায়তা করা একজন অফিস সহকারীর ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। একই সভায় সভাপতির মাসিক মোবাইল বিলও ৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘প্রবিধানমালায় সম্মানী নেওয়ার ব্যাপারে উল্লেখ নেই। এ ব্যাপারে একটা প্র্যাকটিস আছে। তবে সেটা অবশ্যই সহনীয় মাত্রায় থাকা উচিত।’
সূত্র জানায়, ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনটি নিয়মিত কমিটি, একটি বিশেষ ধরনের গভর্নিং বডি এবং পাঁচটি এডহক কমিটি দায়িত্ব পালন করে। এই সময়ে রাশেদ খান মেনন এমপি তিনবার, ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন একবার, মো. আমিনুল ইসলাম একবার এবং ২০১৭ সালের ৪ মে থেকে এখন পর্যন্ত আবু হেনা মোরশেদ জামান তিনটি নিয়মিত কমিটি ও একটি এডহক কমিটির দায়িত্ব পালন করেন। আগামী ৮ নভেম্বর তার চতুর্থ দফা দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বশেষ ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর সভাপতিসহ মোট ১৩ জন নিয়মিত কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু সেই কমিটির এখন মাত্র ৬ জন সদস্য আছেন। প্রবিধানমালা অনুযায়ী, যেকোনো সভায় সিদ্ধান্ত নিতে হলে ১৩ সদস্যের মধ্যে ৭ জনের উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তা না থাকলেও ৬ জনই নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি সর্বশেষ তারা ৭ অক্টোবর অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে এবং নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে মিজানুর রহমানকে দায়িত্ব দেন, যা নিয়মানুযায়ী বৈধ নয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘কমিটির মেয়াদ যেহেতু আগামী মাসের প্রথম দিকেই শেষ হবে। তাই আমরা আপাতত কমিটি ভাঙছি না। তবে শিগগিরই নতুন কমিটি দেওয়া হবে।’
জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ অভিভাবক সদস্য জাহিদুল ইসলাম টিপু খুন হন। গত বছরের ৮ মে সোহেল আহম্মেদ সিদ্দিকী মারা যান, শিক্ষক প্রতিনিধি রোকনুজ্জামান শেখ সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ায় এবং মিজানুর রহমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ায় বোর্ডের রুলস অনুযায়ী তাদের সদস্য পদ নেই। এ ছাড়া খন্দকার মুশতাক আহমেদ গত জুলাই মাসে পদত্যাগ করেন। আর গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে মাকসুদা আক্তার মালা ও ৮ অক্টোবর থেকে গোলাম আশরাফ তালুকদার কারাগারে আছেন।
শিক্ষকরা বলছেন, বর্তমানে কমিটিতে থাকা ৬ সদস্যের মধ্যে শাহাদৎ হোসেন ঢালী ও আমজাদ হোসেন ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। তারা দুজন মিলে এ বছর ১৮ জন করে অবৈধ ভর্তি করিয়েছেন। তারা নিয়মিতভাবে অধ্যক্ষের রুমে বসে থাকেন ও সব কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন। আর তাদের সঙ্গে আগে থেকেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের সখ্য থাকায় তারা একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন।
জানতে চাইলে জিবির সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, ‘সম্মানী বা বড় ধরনের আপ্যায়নের ব্যাপারে আমার জানা নেই। আইডিয়াল একটি বড় প্রতিষ্ঠান। এখানকার গভর্নিং বডিতে থাকলে আত্মীয়স্বজনের চাপে দু-একটা ভর্তি থাকতেই পারে।’ তবে শাহাদৎ হোসেন ঢালীর ফোন বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৪/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়