নিউজ ডেস্ক।।
উদীয়মান দেশগুলোর তুলনায়, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও সরকারি ব্যয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সবার শীর্ষে আছে ফ্রান্স। দেশটির সরকার ব্যয় যেখানে জিডিপির ৫৭ শতাংশ এবং প্রতিবেশী ভারতের সরকারি ব্যয় যেখানে জিডিপির ২৮ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় জিডিপির ১৫ শতাংশেরও কম। এ অবস্থায় বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি ব্যয় বাড়াতে চায় সরকার।
বাংলাদেশ পরপর দুবার স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে উত্তরণের সব শর্ত পূরণ করার মাধ্যমে ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা, আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। সে লক্ষ্যে সরকারি ব্যয় এবং খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে অর্থ বিভাগ। সবকিছু ঠিকভাবেই চলছিল। কিন্তু বাদ সাধে বৈশ্বিক মহামারী করোনা। পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তবে বিশ্ববাজারে পণ্যের উচ্চমূল্য ও সরবরাহ বিঘœসহ আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বিরাজমান সামগ্রিক অস্থিরতা এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারকে আরও সতর্কতার সঙ্গে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিতে হচ্ছে। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
অর্থ বিভাগ মনে করে, সরকারি ব্যয় যদি দারিদ্র্যবান্ধব এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, তা হলে একটি কার্যকর পুনর্বণ্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। এসব বিষয় বিবেচনা করে মধ্যমেয়াদি সরকারি ব্যয় কৌশল (২০২২-২৩ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত) প্রণয়ন করেছে সরকার। প্রণীত কৌশলে রূপকল্প ২০৪১, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং এসডিজির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অগ্রাধিকারমূলক কর্মসূচিতে সম্পদ বরাদ্দের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
গত ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব ও আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজসংবলিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রভাব হ্রাস করা। সেই লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, কৃষি, সমাজকল্যাণ, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং কর্মসংস্থান সুরক্ষার মতো খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও সরকারি ব্যয় এবং খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সরকার বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার জন্য জিডিপির শতাংশ হারে সরকারি ব্যয় ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। জিডিপির শতকরা হিসেবে বাংলাদেশে সরকারি ব্যয় বর্তমানে কিছু উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির তুলনায় কম।
এ অবস্থায় সরকারি ব্যয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মধ্যমেয়াদে সরকারি ব্যয় আগামীতে জিডিপির সাড়ে ১৫ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, সরকার ক্রমান্বয়ে জিডিপির শতাংশ হারে ব্যয় বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সরকারি ব্যয় ছিল জিডিপির ১৩ শতাংশ, যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরে (সংশোধিত বাজেটে) ১৪ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার সংস্কার কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে যেখানে বাংলাদেশে সরকারি ব্যয় ছিল জিডিপির ১৩ শতাংশ, সেখানে ভারত, মালয়েশিয়া এবং ভিয়েতনামে তা ছিল যথাক্রমে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ, ২২.৩ শতাংশ এবং ২০.৪ শতাংশ। তা ছাড়া, উন্নত অর্থনীতিতে সরকারি ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। আগামীতে সরকারি ব্যয় বাড়ানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আর এ জন্য রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
জানা গেছে, গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারি ব্যয় (বাজেট) ২ শতাংশ কমে গেছে। খোদ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) শতকরা হিসেবে বাংলাদেশে সরকারি ব্যয় বর্তমানে কিছু উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির তুলনায় কম।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা (পারস্পেকটিভ প্ল্যান) ২০৪১ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি এবং গুণগত ও মানসম্পন্ন সরকারি সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মৌলিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসেবা খাতসমূহে ব্যয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে সরকারি ব্যয়ের আকার বৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল জিডিপির শতাংশ হিসেবে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
সরকারের আয় যে আশানুরূপ বাড়ছে না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় জিডিপির শতাংশ হিসেবে এনবিআর অবদান বছরের পর বছর ধরে সাড়ে ৭ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যেমন- ২০২০-২০২১ অর্থবছরে জিডিপির শতাংশে এনবিআর অংশ ছিল সাড়ে ৭ ভাগ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এটি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৯ দশমিক ৫ ভাগে। কিন্তু পরে তা সংশোধন করে আট দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। একই চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এই হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, পরবর্তী ২০২৩-২০২৪ এবং ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে প্রাক্কলন করা হয়েছে যথাক্রমে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ ও ৯ শতাংশ। তবে প্রাক্কলন যাই করা হোক, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এই হার অর্জন করাও দুরূহ হয়ে পড়বে।
অর্থ বিভাগ ও আইএমএফ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২১ সালে বেশ কয়েকটি দেশে সরকারি ব্যয় জিডিপির শতাংশে ২০ ভাগের ওপরে ছিল। এর মধ্যে ফ্রান্সের ৫৭ শতাংশ, সুইডেন ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ৩৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ, চীন ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ, ভারত ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়া ২২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ভিয়েতমান ২০ দশমিক ৪ শতাংশ।