শূন্য পদ না থাকলেও ১৮ জন শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ!

নিজস্ব প্রতিবেদক, কুষ্টিয়াঃ নিয়োগের জন্য কোনো শূন্য পদ ছিল না। কিন্তু নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৮ জন শিক্ষক ও কর্মচারী। বিধি অনুযায়ী কোনো নিয়োগ বোর্ডও গঠন করা হয়নি। নিয়োগসংক্রান্ত বিধিবিধানও উপেক্ষা করা হয়েছে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির অন্য সদস্যদের বাদ রেখে প্রধান শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, ভোকেশনাল শাখার ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর ও শিক্ষক প্রতিনিধি পরস্পর যোগসাজশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রেকর্ডপত্র তৈরি করেছেন। এটি জনবল কাঠামো ২০১০ ও সংশোধনী ২০১৩ এবং ২০১৮-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধিরও পরিপূর্ণ পরিপন্থি। এমনই ঘটনা ঘটেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কুমারখালী সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে এসব নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে ম্যানেজিং কমিটির তখনকার সভাপতি বর্তমানে কুমারখালী পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুজ্জামান অরুণের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলার এজাহারে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক নীলকমল পাল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন। এতে আরও ২১ জনকে আসামি করা হয়।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন, কুমারখালী সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম, শিক্ষক প্রতিনিধি ও ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর ভোকেশনাল শাখার মো. আব্দুস সাত্তার, সহকারী শিক্ষক (গণিত) মো. খলিলুর রহমান, সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) আসমা বেগম মালা, সহকারী শিক্ষক (ব্যবসায় শিক্ষা) এসএম আতি বিন বাপ্পী, সহকারী শিক্ষক (সমাজবিজ্ঞান) কুতুবুল আলম, সহকারী শিক্ষক (সমাজবিজ্ঞান) মনিরা পারভিন, সহকারী শিক্ষক (জীববিজ্ঞান) লুৎফুন নাহার লাবনী, সহকারী শিক্ষক (ভৌতবিজ্ঞান) শেখ মো. সেলিম রেজা, কম্পিউটার ডেমোনেস্ট্রেটর (ভোকেশনাল শাখা) সাম্মী আক্তার, সহকারী শিক্ষক (ভৌতবিজ্ঞান) আব্দুল্লাহ মোহাম্মদী, সহকারী শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা) আমিরুল ইসলাম, সহকারী শিক্ষক (সমাজবিজ্ঞান) মো. শহিদুল ইসলাম, নিন্মমান সহকারী কম্পিউটার অপারেটর বাসনা রানী কর্মকার, আয়া রুপালী খাতুন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী সনজিদ কুমার বাঁশফর, নৈশপ্রহরী মো. নাসিম হোসেন, অফিস সহায়ক (পিয়ন) মো. আলমগীর হোসেন, দারোয়ান মো. আমিরুল ইসলাম, বিজ্ঞান ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট খাদিজাতুল কোবরা ও কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন।

এজাহার অনুযায়ী, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৮-এর সংশোধিত পরিপত্র অনুযায়ী স্কুল ও কলেজে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এখানে প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে একটিমাত্র পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। অপরিহার্য থাকলেও নিয়োগ বোর্ডে ডিজির কোনো প্রতিনিধি ছিল না। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সামসুজ্জামান অরুন ও প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেমের স্বাক্ষরে নিয়োগ বোর্ড গঠিত ও পরিচালিত হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ‘কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২২/১০/২০১৫ খ্রি. তারিখ বা তার আগের সময়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে কোনো পদে নিয়োগ দেয়া হলে তা অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।’ ওই ১৮ জন শিক্ষক কর্মচারীর নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি, নিয়োগ এবং যোগদান সবই ২২.১০.২০১৫ খ্রি. তারিখের পরে সম্পন্ন করা হয়েছে (কম্পিউটার শিক্ষক আসমা বেগম মালা ব্যতীত)। সেই হিসেবে পরিপত্রকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া মূল্যায়নপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একটি পদের বিপরীতে ন্যূনতম তিনজন প্রার্থীর পরীক্ষায় অংশ নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রত্যেক পদের বিপরীতে তিনজনের প্রাপ্ত নম্বর প্রদর্শিত হলেও অন্য দুজন প্রার্থীর শুধু দরখাস্ত বা আবেদন ছাড়া অন্য কোনো কাগজপত্র, ডকুমেন্টস, ব্যাংক ড্রাফট নম্বর ও সার্টিফিকেটের কপি আবেদনপত্রের সঙ্গে ‘সংযুক্ত নেই’ মর্মে দেখা যায়। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির অন্য সদস্যদের বাদ রেখে নিয়োগ পরীক্ষার মূল্যায়নপত্রে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সামসুজ্জামান অরুন ও প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেমসহ শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে আব্দুস সাত্তার এবং ভোকেশনাল শাখার ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর খলিলুর রহমানের স্বাক্ষরে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা, ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৮ অনুযায়ী ওই বিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো শিক্ষক বা কর্মচারীর শূন্য পদের প্রাপ্যতা না থাকলেও এমনকি মাউশি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না থাকলেও বিধিবহির্ভূতভাবে পরস্পর যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

বিদ্যালয়টিতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি এবং ভোকেশনাল শাখায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১০ এবং ২০১৩ অনুযায়ী মোট ২৭ জন শিক্ষক, ইনস্ট্রাকটর, কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। সেখানে আর কোনো শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের জন্য শূন্য পদ অবশিষ্ট ছিল না। নিয়োগ বিধি অনুযায়ী কোনো নিয়োগ বোর্ড গঠন না করে এবং নিয়োগসংক্রান্ত সব বিধিবিধান উপেক্ষা করে তখনকার স্কুল ম্যানেজিং কমিটির অন্য সদস্যদের বাদ রেখে প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সামসুজ্জামান অরুন, ভোকেশনাল শাখার ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর আব্দুস সাত্তার ও শিক্ষক প্রতিনিধি খলিলুর রহমান পরস্পর যোগসাজশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রেকর্ডপত্র তৈরি করে বিদ্যালয়টিতে অতিরিক্ত ১৮ জন শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেন, যা জনবল কাঠামো ২০১০ ও সংশোধনী ২০১৩ এবং ২০১৮-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং মাউশি অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বিধির পরিপূর্ণ পরিপন্থি।

বিদ্যালয়টিকে অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যসংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত শেষে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, কুমারখালী পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৮৬৩ সালে স্থাপিত হয়। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ ঘোষণা এবং একইসঙ্গে সব ধরনের নিয়োগ, পদোন্নতি ও স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আদেশ জারি করা হয়। একই বছরের ১৫ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটি সরকারীকরণ করা হয়। তখন বিদ্যালয়ের নামকরণ হয় ‘কুমারখালী সরকারি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুমারখালী, কুষ্টিয়া।’

অভিযোগের বিষয়ে সামসুজ্জামান অরুন বলেন, ‘ঘটনার সময়কালে আমি সভাপতি ছিলাম না। আমি জানিও না কিছু। দুদকের কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, সভাপতির অনুমোদন ছাড়া তো কোনো নিয়োগ হয় না, সেই হিসেবে আমাকে আসামি করা হয়েছে। আমাকে একবারও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। আমাকে ডাকেওনি। আমার সংশ্লিষ্টতা থাকলে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। আসলে আমাদের কুমারখালীর রাজনীতি ক্রিটিক্যাল হয়ে গেছে। আমার পৌরসভার নির্বাচনের আগেও আমাকে হেনস্তা করা হয়। সেই গ্রুপই এখনও লেগে আছে। তারাই সুযোগটা নিয়েছে।’

নিয়োগ পরীক্ষার মূল্যায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ম্যানেজিং কমিটির রেজুলেশনে এসব শিক্ষককে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এদের বিষয়ে তো দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার দরকার নেই।’

সামসুজ্জামান অরুন  বলেন, ‘আমি যখন সভাপতি ছিলাম, তখন এই স্কুলটা সরকারি করা হয়। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ডিজি অফিসের কর্মকর্তারা এসে সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যান। তারা জানিয়ে যান, এখন থেকে সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী সব করতে হবে। তখন থেকে সভাপতি ইউএনও। সরকারীকরণের আগে আমাদের স্কুলের শিক্ষক শাহজালাল এনটিআরসি থেকে কাগজপত্র জাল করে এনে বিভিন্ন জনকে নিয়োগ দেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় শুনানি শেষে তাকে বরখাস্ত করা হয়। দুই বছর পর তিনি অন্য স্কুলে যোগ দেন। তিনি আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে দরখাস্ত করেন।’

দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারি পরিচালক নীল কমল পাল  বলেন, ‘এটা মাউশির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। সে আলোকে মামলা করা হয়েছে।’

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৮/০৩/২০২৩

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়