শীর্ষ কর্তাদের সন্তানেরা কেউই দেশে পড়ে না, শিক্ষা নিয়ে ভাববে কে ?

আর রাজীঃ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার যে উদ্দেশ্য, সেটা বাস্তবায়নের যে প্রক্রিয়া, আমরা কিন্তু দেশের সব মানুষকে প্রকৃতভাবেই শিক্ষিত করতে চাই। মানুষ এমনভাবে শিক্ষিত হবে যাতে সেই ব্যক্তি তার মর্যাদাবোধ, আত্মসম্মান রক্ষা করতে পারে এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে। বড় কথা হচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় সে যেন থাকতে পারে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক জীবনযাপন করতে পারে। এটাই তো প্রকৃত শিক্ষা। আমাদের শিক্ষার মূল ধারণা ছিল, যেটা আমাদের সংবিধানেরও মূল কথা সর্বক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমতা থাকতে হবে। সর্বোপরি মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্যই আমরা চাইছিলাম, শিক্ষাগ্রহণের শুরুতেই লেখাপড়া এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেন কোনো ধরনের বৈষম্য তৈরি না হয়। কিন্তু সেটা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। অনেক আগেই শিক্ষায় বৈষম্য তৈরি হয়ে গেছে। শহরে আবার কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম, সরকারি-বেসরকারি, বিদেশি নিয়ন্ত্রিত স্কুল অসংখ্য।

একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেকটার শিক্ষা পদ্ধতির কোনো মিল নেই। আবার আরেকটা বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে ভাষার ক্ষেত্রে। একদিকে ইংরেজি আরেকদিকে আরবি-উর্দু। মাদ্রাসাগুলোতে তো একটা মিশ্র শিক্ষা পদ্ধতি চলছে। এর সবকিছুই একটা জগাখিচুড়ি মতোন অবস্থা। যে কারণে দেশের সব মানুষের জন্য একইরকম শিক্ষা পদ্ধতি চালু করতে পারছি না। অথচ সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা যে চালু করা যেত না তা কিন্তু নয়। আমি মোটেও বলছি না, শিক্ষাব্যবস্থায় বৈচিত্র্য থাকা খারাপ। কিন্তু এসব কীভাবে চলছে, তা তদারকির জন্য রাষ্ট্রের একটা তদারকির দরকার ছিল। আমাদের সমাজে পিছিয়ে পড়া বিশাল সংখ্যার মানুষ কীভাবে ‘উন্নত শিক্ষা’ পাচ্ছে, তাদের বিষয়ে রাষ্ট্রের যে বিনিয়োগ দরকার ছিল তা করা হয়নি। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। এখনো শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপির ২ শতাংশেরও কম বিনিয়োগ। আমাদের লক্ষ্য কিন্তু ছিল, ৪ শতাংশ। অথচ তা হলো না। ফলে গোড়াতেই তো একটা বিশাল বৈষম্য রয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা ‘বিজ্ঞান’ কীভাবে শিখবে সেটা নিয়েই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তুলে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন শাখা। এর ফলে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রকৃত গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা নিয়ে এক ধরনের জগাখিচুড়ি তৈরি হয়েছে। নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে মাধ্যমিক পর্যায়ে উচ্চতর গণিতের প্রতি অবহেলা, বিজ্ঞানের প্রতি অবহেলার পরও, এর মধ্য দিয়েই আমরা একটা শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে তুলতে চাচ্ছি। বিশেষ করে, বাংলা মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা শুধু কর্মী তৈরি করতে পারব। কোনো নেতৃত্ব তৈরি হবে না, সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরি হবে না, ভালো মানুষ তৈরি হবে না। কেবলমাত্র কারখানার কর্মী তৈরি হবে।

পরিস্থিতিটা এরকম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, আমাদের জাতীয় আকাক্সক্ষাটা পরিষ্কার না। আমরা আসলে কী চাই, তা পরিষ্কার নয়। ১৯৭১ সালে আমাদের মধ্যে যে বন্ধন তৈরি হয়েছিল, তা কিন্তু আর নেই সেটা অস্পষ্ট, ঘোলা। আসলে আমরা জানিই না, আমরা কী চাই? ভুলে গেছি আমরা গণতান্ত্রিক, মানবিক, সাম্যের একটা রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। এখন আমরা একটা শ্রেণিবিভাজিত রাষ্ট্র করতে চাচ্ছি। যেখানে কেউ কেউ ইংরেজি মাধ্যম বা বিদেশি ভালো স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে আমাদের মাথার ওপরে বসবে। রাজনীতি, ব্যবস্থাপনা অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তারাই মূল ভূমিকা পালন করবে। আমরা শুধু প্রচুর শ্রমিক সরবরাহ করব।

যত যাই বলি, এটা কিন্তু একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। সেই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তৈরি হবে। তখন একটা সমাধান আসতে পারে। এর আগে না।

একটু এগিয়ে কিছু বলি। এত জটিল ভাবে না দেখে, বিষয়টি কিন্তু আরেকভাবে দেখা যায়। যারা প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক তারা কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিলেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা তো খুবই শোচনীয়। এটা নিম্নগামী বললেও ভুল হবে। এটা আসলে অধঃপতিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন কোনো পড়াশোনা হয় না। জ্ঞানচর্চার কোনো পরিবেশ নেই। খামাখা কিছু অর্থ করদাতারা ব্যয় করে। হয়তো একটা শ্রেণি তাইরে নাইরে করে, সেই টাকা উদরস্থ করে। আর কিছু না। আমাদের সমাজে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অবদান আছে বলে মনে হয় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সংস্কার দরকার। ১৯৭৩ সালের এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশের ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এর বাইরে যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলো আসলে বিশ্ববিদ্যালয় নামের কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয় হবে, রাষ্ট্রের ভেতরে একটা রাষ্ট্র একটা আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা তৈরি করবে। সেই পরিস্থিতি কিন্তু নেই। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই স্বায়ত্তশাসনও এখন অর্থহীন হয়ে গেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভিসি নিয়োগ হয়, অধিকাংশই দু-নম্বরী ধারায় চলছে। এর কোনো সময়সীমা নেই। কখনো কখনো দুই বছরের জন্য। কখনো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। অনেকে নানাভাবে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকে নিজের মতো করে একটা প্যানেল তৈরি করেন। এখানে স্বায়ত্তশাসনটা খর্ব হয়ে যায়। আমাদের উপউপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সবকিছুই সরকারের স্বাধীন সিদ্ধান্তে হচ্ছে। সিনেট-সিন্ডিকেট যদি ঠিকমতো কাজ করত, তাহলে একটা কথা ছিল। এই যখন অবস্থা, তখন নৈতিকতার বিষয়টিই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তখন আমরা কিন্তু প্রকৃত ‘মানুষ’ তৈরি করতে পারছি না। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারাই তো সবকিছু করছে। এখানে যখন শুরুতেই একটা ঝামেলা হয়, অন্যরকম চর্চা হয় তখন আর কোনো পথ খোলা থাকে না। সেটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় একটা উচ্চ নৈতিকতার জায়গা। তখন শিক্ষার বড় দিকটাই ভেঙে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়েই আমরা বোধসম্পন্ন ‘মানুষ’ তৈরি করতে পারছি না, সেই তারাই তো স্কুল-কলেজে যাচ্ছেন। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে অস্থিরতা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। যে কারণে বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা।

বিষয়টা বিবেচনা করতে হবে, একেবারে ওপর থেকে। এরপরও যদি সব জায়গায় কাজ করার উপযোগী পরিবেশ থাকত, তাহলে একটা কথা ছিল। পৃথিবীতে এটা মনে হয় খুব কমই দেখা যায়, যেখানে শিক্ষার মান অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিম্নগামী যা আমাদের দেশে হচ্ছে। সর্বব্যাপী দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এই দায় কার? এটা একেবারেই বিশৃঙ্খল শিক্ষা ব্যবস্থারই প্রকট চেহারা। এর মানে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো কার্যকারিতাই নেই। আমরা কোনো সেক্টরেই প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ পাচ্ছি না। না পেলেই বিভিন্ন জায়গায় অদক্ষতা তৈরি হয়, অরাজকতা তৈরি হয় যে কারণে এই অবস্থা।

এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। কীভাবে আমরা শিক্ষাকে উপলব্ধি করব? বৈচিত্র্যের মধ্যে কীভাবে ঐক্য নিয়ে আসব এবং বৈষম্য কমাব। শিক্ষাব্যবস্থা কোন ধরনের হবে, কীভাবে চলবে আবারও বলছি, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এখন শিক্ষানীতির যে অরাজকতা, সম্মিলিত অংশগ্রহণের অভাবই এর মূল কারণ। যে কারণে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা।

আমাদের শীর্ষ আমলা, শীর্ষ রাজনীতিবিদ, শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের কোনো সন্তানই কিন্তু এদেশে পড়াশোনা করে না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, তাদের কোনো সন্তান নেই। দেখা যাবে, এটা শতকরা ১০০ ভাগ । এমনকি সরকারি স্কুলেও তারা পড়াশোনা করে না। তাদের সন্তানরা সব পড়াশোনা করছে বিদেশে। ফলে এদেশের লেখাপড়া নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উপলব্ধি করতে হবে দেশের প্রতি, জনগণের প্রতি তাদের একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। আবার জনগণকেও সচেতন হতে হবে, নেতৃত্ব তৈরির ব্যাপারে। এর আগে শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন।

লেখক: শিক্ষক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২০/০৯/২০২৩

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়