শিশুদের বাঁচাই, শিক্ষকদের বাঁচাই

ফাতেমা তুজ জোহরাঃ  যেকোনও মানুষ যে সম্পদটিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তা হলো তার সন্তান। নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে, সবচেয়ে বেশি কষ্ট স্বীকার করে যেকোনও মূল্যে মানুষ সন্তানকে রক্ষা করতে চায়। সেই পরম আদরের শিশুটিকে সে একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো সেই প্রতিষ্ঠান, যা মানব সমাজের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটি নিয়ে কাজ করে, মানুষের সবচেয়ে মমতার স্থানটিকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে।

দিনের একটি বড় সময়, জীবনের অনেকটা সময় একটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাটায়। নির্মম হলেও সত্য, সেখানেই সেই শিশুটি প্রথম জানতে পারে যে বাবা-মা যে তাকে রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যার কথা বলেছিল তা সত্য নয়। সে যে কতটা অদক্ষ, কত দোষ তার তা সে স্কুলে না এসে জানতে পারতো না। সে যে কিছুই পারে না, দেখতে ভালো নয়, জীবনে তার দ্বারা কিছুই হবে না—এ রকম কিছু কথাও তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে শুনতে হয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই শিশুর সমাজের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্থান। স্কুল তো সমাজেরই চিত্র, তাই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই যে তাকে শক্ত করে তুলবে, জীবনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে তাতেও সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু যোগ্যরা টিকে থাকবে, অযোগ্যতার যে স্থান নেই—স্কুল যে শিশুদের এ শিক্ষা দেয় তার যৌক্তিকতা কতটুকু? আর যৌক্তিক যদি না হয় তাহলে তার সমাধান কী হবে?

যেকোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রে থাকেন শিক্ষক। তাদের শিক্ষাতেই শিশুরা বড় হয়ে ওঠে। একজন শিক্ষকের দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি অসংখ্য শিক্ষার্থীর বাকি জীবনে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোনও না কোনও প্রভাব ফেলে। তাই দুদিন কিংবা দুই যুগের জন্যই হোক না কেন, যখনই শিক্ষক হবার সুযোগ কেউ পাবেন, তখন আমরা কোনও দর্শন নিয়ে শিশুদের সামনে দাঁড়াচ্ছি সেটির প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।

একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আমার সামনে কী দেখছি? আমি কী দেখছি হইচই চেঁচামেচি করা বিরক্তিকর একদল শিশু? যারা পড়া পারে না, নিয়ম-শৃঙ্খলা মানে না, যাদের শেখাতে আমাদের অনেক খাটতে হবে, জীবন কয়লা হবে। এদের দিয়ে কিছু হবে না– যদি এরকম কারও উপলব্ধি হয় তাহলে তার সম্ভব হলে শিক্ষকতা থেকে সরে যাওয়া দরকার। জীবন-জীবিকা নির্বাহের বহু পথ এই পৃথিবীতে আছে। সেগুলোর কোনও একটা সে যেন খুঁজে নেওয়ার একটু চেষ্টা করে।

যদি শিশুদের সামনে দাঁড়াতেই হয় তবে আমাদের ভাবতে শিখতে হবে যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি অপার সম্ভাবনার সামনে। এরা স্রষ্টার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, মহাবিশ্বের অন্যতম বুদ্ধিমান প্রাণী। এরা সবাই নিশ্চিতভাবেই সমান হবে না। আচরণে, শারীরিক সৌন্দর্যে, অর্থবিত্তে, অর্জনে একই স্তরে দাঁড়াবে না। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই মানুষ। এরা তাদের পরিবারের প্রাণ, সমাজের রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এরকম ভাবনা ভাবতে নিজেকে বাধ্য করতে হবে, দরকার হলে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।

কারণ, একটি শিশু কী অনাবিল সৌন্দর্য অফুরন্ত প্রাণশক্তির উৎস। কী ভীষণ মমতাই না তাকে দেওয়া উচিত, পরম মমতায় বিদ্যালয় তাকে জড়িয়ে রাখবে, সকল অশুভ থেকে এই বিদ্যালয়ে থাকার সময়টাতে সে থাকবে নিরাপদ। ভাবতে শিখতে হবে যে আমরা আজ এই সময়টাতে তাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করছি, আমাদের শুদ্ধ পবিত্র অস্তিত্ব, শুভ্র চিন্তা এই শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারবো। আমাদের আচরণ দিয়ে তাদের জীবনে তৈরি করতে পারবো পরম সুন্দর স্মৃতি।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম কখনও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে না। বিশেষত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন তো নয়ই। খুবই ব্যতিক্রম থাকতে পারে তবে তা সর্বসাধারণের আলোচনায় আনছি না। গ্রামে বা কোনও দুর্গম অঞ্চলে কোনও শহরে শিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ চাকরি করবে এ দুঃস্বপ্ন কল্পনায়ও আসে না কারও। যথাসঙ্গত কারণও রয়েছে অনেক। আমাদের স্থূল সামাজিক মানমর্যাদার যে বিচারদণ্ড তাতে শিক্ষকের মর্যাদা যে কোথায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারও চেয়ে যদি বড় কোনও কারণ থেকে থাকে তবে তা আর্থিক। অর্থ এক ধরনের মর্যাদা তৈরি করে, তাও তো এখানে নেই।

তারপরও প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে শিক্ষক হিসাবে যারা আসেন কিংবা শিক্ষকতাকেই যারা পেশা হিসেবে নেন তাদের প্রতি অনুরোধ জানাই– আপনার সামনে ৩০ থেকে ১০০, যত শিশুই থাকুক তারা তাদের জীবনের মূল্যবান অনেকটা সময় আপনার সাথে কাটাবে। আপনি সেই মানুষটি যার দিকে তারা এখন তাকিয়ে আছে, বুঝে বা না বুঝে সে এখন শিখছে। আপনি তাকে যে বিষয়টি পড়াবেন তার বাইরেও সে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখছে।

তাই আপনার হাসি, আপনার মমতামাখা কণ্ঠস্বর, আপনার সহানুভূতি, ধৈর্য, আপনার তিরস্কারের ধরন, আপনার ঘৃণা এবং ভালোবাসা সব সে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শিখছে। আমরা নিজেকে মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করি যে সামনের প্রতিটি শিশু একদিন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হবে, আমিই সেই মানুষ যে এই মুহূর্তে এই সুযোগটি পেয়েছি, আমি তার ভিত্তি গড়ে দিতে পারি।

শিশুরা আমাদের সবচেয়ে পরিশুদ্ধ সংস্করণ, তার সামনে ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার এই সুযোগ, জাতি গঠনে এর চেয়ে বড় অবদান রাখার সুযোগ মানুষ কিন্তু তার এক জীবনে খুব বেশি পায় না।

তাই যা ইচ্ছা তাই বলা থেকে বিরত থাকতে সচেষ্ট হই। মনের ভেতরটা যদি অন্ধকারও হয় তবু সেই অন্ধকারকে বাইরে আসার পথে বাধা দিই। একটি নেতিবাচক কথা একজন শিক্ষার্থীর মনে সারা জীবনের জন্য প্রোথিত হয়ে যেতে পারে। একটি ভুল কথা যে বেদনার পরিণতি ডেকে আনতে পারে তা থেকে শিশুদের বাঁচাই।

তবে আমরা জানি, প্রতিদিন যে মানুষগুলো হাসিমুখ নিয়ে শিশুদের সামনে দাঁড়াবেন তারাও তো ফেরেশতা নন, রক্ত মাংসের মানুষ। তাদের জীবনে রয়েছে নানাবিধ যন্ত্রণা, বঞ্চনা, দুঃখ, তীব্র বেদনা। প্রতিদিন এসব উপেক্ষা করে পাঠদানের সময় হাসিমুখে দাঁড়ানো সহজ নয়। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক যদি মারমুখী অবস্থান নেয়। শিক্ষকদের ভুল-ত্রুটির অর্থ সেটি নিশ্চিতভাবেই শিক্ষার্থীরা শিখবে! সেটি সংশোধনে দিতে হবে চরম ধৈর্যের সাথে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশু-শ্রেণির শিক্ষকদের বেশিরভাগেরই প্রশিক্ষণ নেই। যে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান তিনি অর্জন করেছেন সেটি তাকে শিক্ষকতা করার যোগ্য তো করে তোলেনি, হয়তো তিনি শিখেছেন গণিত, রসায়ন কিংবা বাংলা। শিক্ষক হতে তাকে তো কেউ শেখায়নি। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আছে প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ। এখানে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

আবার শিক্ষকদের প্রেষণারও প্রয়োজন আছে। হয়তো বা তিনি বাসায় তার অসুস্থ সন্তান কিংবা মাকে রেখে আজ পাঠদানে এসেছেন, কিংবা আর্থিক সংকট, শারীরিক জটিলতায় আছেন। অন্য কোনও কাজ যদি করতেন তবে হয়তো বা টেবিলে মুখ গুঁজে নীরবে কাজ চালিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু শিক্ষকদের সেই সুযোগ তো নেই। তাকে মুখোমুখি হতে হবে একদল শিশু বা কিশোর-কিশোরীর, যারা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা যে সবাই হাসিমুখে নীরবে পাঠ গ্রহণে ব্রতী হয়েছে তা তো নয়! বরং উল্টোটাই সত্যি তারা চাইছে সমস্ত দুরন্তপনা ছড়িয়ে দিতে, শুধু পড়াশোনা ছাড়া পৃথিবীর আর সব বিষয়েই তারা আগ্রহী। তাই তাদের সামলানো সহজ কাজ নয় মোটেই।

কঠিন এই কাজটাকে সহজ করতে পারে প্রশাসন এবং অভিভাবকরা। যে মমতামাখা হাত শিক্ষক আমাদের সন্তানদের দিকে বাড়িয়ে দেবেন বলে আশা করি, আমরা সেই একই মমতায় শিক্ষকদের সাহায্য করতে হবে, তাদের প্রশাসনকে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তবেই প্রতিটা স্কুল হয়ে উঠবে শিক্ষার্থীর জন্য আদর্শ স্থান।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইগনাইট পাবলিকেশন্স

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৫/১১/২০২৩ 

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়