ড. কাজী হানিয়াম মারিয়া: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে ঢাকার প্রাইম লোকেশনে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী সাতটি সরকারি কলেজকে ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা এই সাত কলেজের উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধিই ছিলো এর অধিভূক্তির প্রধান লক্ষ্য। ওই বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তৎকালীন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারের নির্দেশে এই অধিভুক্ত কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা নেয়ার কাজ শুরু করেন। পরের বছর থেকে ভর্তি প্রক্রিয়াও শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং দুই বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী সাত কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী যেই লক্ষ্যে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার কথা বলেছিলেন সেই লক্ষ্য কি পূরণ হচ্ছে? পরীক্ষা কমিটি পরিচালনা করা এবং পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে আমি বলবো, পুরোপুরি ব্যাহত হয়েছে এবং হচ্ছে।
অধিভুক্তির প্রথম থেকে বেশিরভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুখে স্বীকার না করলেও এর বিপক্ষে ছিলেন। দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কোন হোমওয়ার্ক ছাড়া এত বড় দায়িত্ব মাথায় নিয়েছিলেন! সেই তাড়াহুড়ো সিদ্ধান্তের খেসারত হলো সাত কলেজের সেশনজট, সময়মতো পরীক্ষা-রুটিন-ফলাফল প্রকাশ না হওয়া এবং বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবিতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-রাস্তা বন্ধ, ফলোশ্রুতিতে ঢাকা অচল। এসব তথ্য মোটামুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট না এমন সকলেই জানেন।
এবার একটু নজর দেই ভেতরের দিকে। প্রথমে ছাত্রছাত্রীদের দিয়েই শুরু করি।চাহিদার তুলনায় অল্প সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে সংখ্যাতিরিক্ত ছাত্রের ক্লাস নেয়া হয় এবং নিয়মিত যেখানে ক্লাস হয় না সেখানে সিলেবাস শেষ করার প্রশ্নই আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস এবং কারিকুলাম ফলো করার কথা থাকলেও তারা এখন অব্দি বাংলায় পরীক্ষা দিয়ে চলেছে।বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য সাত কলেজের কোনটারই ল্যাব ফ্যাসিলিটি নেই। পরীক্ষার সময়ও তারা পাঁচজন মিলে একসাথে জোট বেঁধে পরীক্ষা দেয়।ওখানে ইনভিজিলেশন দেয়া না দেয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অনেকেই বলে থাকেন যে, সাত কলেজের ছেলেমেয়েরা মেধাবী না। নির্দয়ের মতো এই বাজে মন্তব্যটি আর করবেন না। পড়ালেখার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করে না দিয়ে হঠাৎ করে এই ছাত্রদের কাছ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটপুট কি আশা করা উচিত? পরীক্ষা নিতে গিয়ে এবং খাতা দেখার সময় আমি এমন অনেক ছাত্রছাত্রী পেয়েছি যারা আমার নিজের ডিপার্টমেন্ট থেকেও ভাল জানে আবার এমন অনেককে পেয়েছি, ঢাকার বাইরের ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েও শুধু ঢাকায় পড়বে বলে যায়নি। প্রশ্ন আসতে পারে, তারা এখন এমন অযৌক্তিক দাবি কেন করছে? এর জন্যও দায়ী আমরা। কেন আমরা আমাদের সিজিপি এর বার নামালাম? করোনায় পড়ানো হয়নি এমন তো না। সিলেবাস কমানো হয়েছে। কিন্তু বার নামানো একদমই ঠিক হয়নি!
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিকে তাকাই। আগের মত নিয়মিত ল্যাব-ক্লাস-পরীক্ষা নেবার পাশাপাশি সাত কলেজের পরীক্ষার প্রশ্ন করা -খাতা দেখা, ব্যবহারিক ও ভাইবা নিতে সেই কলেজে যাওয়া।ঢাকা-ইডেন-বদরুন্নেসা বাদে বাকী চারটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে।ঢাকার জ্যাম পেরিয়ে পরীক্ষা নিতে যাওয়া মানে রীতিমত যুদ্ধ করা এবং সেদিন নিজের কর্মস্হলে আর হাজির হওয়া যায় না। এতে নিজেদের ছাত্রদের না ক্লাস নেয়া যায়, না গবেষণায় সাহায্য করা যায়। ব্যাক্তিগত অর্জনের কথা যদি বলি তাহলে আমি বাংলা টাইপ করতে শেখার পাশাপাশি বিজ্ঞানের কঠিন শব্দের বাংলা শিখেছি। স্বীকার করছি আমার একাউন্টেও ভাল এমাউন্ট জমা হয়েছে কিন্তু সেটা আমার পরিশ্রমের তুলনায় নগন্য এবং সময়মত পাইনি। তাই টাকাপয়সার জন্য শিক্ষকরা পরীক্ষা নিতে যায় এই কথাটা বলে উনাদের পরিশ্রমকে ছোট করবেন না।শিক্ষকরা রোবট না যে সারাক্ষন ক্লাস-পরীক্ষা নেয়া-খাতা দেখতে থাকবে।
সাত কলেজের পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের একচুল ছাড়ও দেয়নি। দিনে ১৮টা করে খাতা দেখা, সময়মত খাতা জমা দেয়া, রেজাল্ট বের করা ক্রমাগত তাগাদা দিতেই থাকেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ফেলে সাত কলেজের কাজ শেষ করতে হয়েছে। তারপরও আমরা ব্যর্থ। কারণ খুব স্পষ্টই। আপনার কাজের সীমাবদ্ধতা আছে।একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের কাজ করতে পারবেন না। আর ছাত্রদের তো অভিযোগের শেষ নেই। কিছু অভিযোগ যৌক্তিক, কিছু নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকা, কিছু সাত কলেজের শিক্ষকদের নিয়ম না জানার কারণে এবং অতি অবশ্যই কিছু অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সদিচ্ছা-সময়ের অভাব!
এসব কারনে প্রথম থেকেই সাত কলেজের ছাত্ররা আন্দোলন করছে। অধিভুক্তির উচ্ছ্বাস প্রথম পরীক্ষা দেবার পরই চলে গিয়েছিলো। প্রথমে তারা ক্যাম্পাসে আন্দোলন করতো, এখন ক্যাম্পাসের বাইরের পথ আটকে করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অনুযায়ী ছাত্রদের শেখানো-পড়ানো হলেই সেখান থেকে কিছু আশা করা যায়। কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট প্রকট। একটি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে মাত্র দুজন শিক্ষক ছিলেন। সবচেয়ে বেশি শিক্ষক মনে হয় ইডেন এবং ঢাকা কলেজের, সেটাও ছাত্রের তুলনায় অপ্রতুল।বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতেই তো শিক্ষক সংকট, সেই অল্পসংখ্যক শিক্ষক দিয়ে বিভাগের কাজই সময়মত শেষ করা যায় না, সেখানে সাতকলেজের কাজ কিভাবে শেষ হবে! তারপরও শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট দূর করে ফেলেছে। কিন্তু সাত কলেজের দায়িত্ব পালনের মত লোকবল ঢাবির নেই।তাই ঢাবির গলায় কাটার মত সাত কলেজ ঝুলে আছে।
তারপরও বলবো নীতিনির্ধারণী বোর্ডের উচিত হবে না, ছাত্রদের অন্যায় -অযৌক্তিক দাবী মেনে নেয়ার। প্রথম তিন বছরে জিপিএ ২ পেলেই পাস দেয়ার নিয়মই বরং বাতিল করা উচিত। সেখানে ১ পেলে প্রমোশন মানা মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নামানো। সাত কলেজের মান বৃদ্ধি যদি করতেই হয় তাহলে এবার একটু হোমওয়ার্ক করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অধিভুক্তি বাতিল হলেও যেন তাদের উন্নত শিক্ষার পরিবেশ দেয়া হয়। গত সাত বছরে সাত কলেজের মান কতটুকু বৃদ্ধি হয়েছে সেটা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
লেখক : অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩০/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়