আমিরুল আলম খান :
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে চরম নৈরাজ্য। একের পর এক কালাপাহাড়ি নীতি দেশের শিক্ষার সর্বনাশ ঘটিয়েছে। নাগরিক সমাজ অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে প্রতিবাদ করছেন বটে, কিন্তু এক শ্রেণির সুবিধালোভীরা তা আঁতুড়ঘরেই খুন করতে চেয়েছে সব সময়। সরকারের অভ্যন্তরভাগ জনতুষ্টিবাদের জয়জয়কারে ভেসে গেছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরগুলো। অনেকে প্রতিবাদকারীর কপালে জুটেছে পাগলের তকমা। প্রায় উন্মাদ প্রমাণে মত্ত হয়েছে স্বার্থবাদী মহল।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু রূঢ় বাস্তবতার স্বীকৃতি ও কঠোর নির্দেশনা আমাদের আশাবাদী করেছে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর এমন কিছু নির্দেশনার উল্লেখ করব যা আমাদের হতাশার সমুদ্র থেকে পরিত্রাণের আশা জাগায়।
একনেকের গতকালের (৯ জুলাই, ২০১৯) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আমাদের উচ্চ শিক্ষায় ছড়িয়ে পড়া মারাত্মক ক্যান্সার শনাক্ত করে তা নিরাময়ের ঠিক পথটি দেখিয়ে দিয়েছেন।
সরকারি কলেজগুলোকে পুনরায় নিজ নিজ অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যায় লাগাম টানতে বলেছেন। মঙ্গলবার (৯ জুলাই) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশনা দিয়েছেন (দৈনিকশিক্ষা ডটকম, জুলাই ১০, ২০১৯)।
একই সভায় প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক দলবাজি, দুর্নীতি, শিক্ষাবাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছেন। তিনি উচ্চ শিক্ষায় বিপুল শিক্ষার্থী ভর্তির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দায়িত্ব যে গবেষণা ও নতুন জ্ঞান সৃজন সে বিষয়টিও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যে দুর্নীতির আখড়া সেটা প্রকাশ করতেও তিনি দ্বিধা করেন নি।
আর এসব অনিয়ম দূর করতে তিনি সঠিক পরিকল্পনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যথার্থ বলেছেন, সব সরকারি কলেজ স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতে হবে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিঞ্জিরমুক্ত করতে হবে।
তবে, শুধু সরকারি কলেজই নয়, সকল বেসরকারি কলেজকেও স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন জানাবো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিলুপ্ত ঘোষণা করা হোক।
দুনিয়ার কোথাও এখন কেবল স্বীকৃতিদান করে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় দায়িত্ব শেষ করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ‘সার্টিফিকেট বিলানো’ হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নিরন্তর গবেষণা, নতুন জ্ঞান সৃজন, মুক্ত জ্ঞানচর্চা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্লাসে পড়ায়; যেন একেকটা মাধ্যমিক স্কুল। এক ক্লাসে অন্তত দেড় শ’ ছাত্র! শিক্ষক লেকচার দেন, হালে পাওয়ার পয়েন্টে বায়স্কোপ দেখান। কোনো শিক্ষার্থীকে চেনেন না। ছাত্র-শিক্ষক নৈকট্য নেই, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই। হাজার হাজার ছাত্র হলো গ্রহীতা, শিক্ষক হলেন দাতা!
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার নেই, গবেষণা তো হনুজ দূর অস্ত। গ্রন্থাগার নেই বলাই ভালো। ছাত্রদের ভরসা নীলক্ষেতের ফটোকপির দোকান আর কোচিং সেন্টার। সেখানে নোট, এসাইনমেন্ট, গবেষণাপত্র সব মেলে। সবকিছুই রেডিমেড। লাইব্রেরি কতটা বেদরকারি হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে, তা বোঝা গেল এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের আলোকসজ্জায়। পুরো লাইব্রেরি পড়ে রইল তিমির আঁধারে। লাইব্রেরি শুধু নিষ্প্রয়োজনীয় নয়, তা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অংশই নয়! কোন সভ্যদেশ হলে শুধু এই উপলব্ধির অভাবে উপাচার্যের নোকরি খতম হত।
বাজারি বিদ্যে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিলেই ডিগ্রি নিশ্চিত। শিক্ষার্থীরা তাই ল্যাবে নয়, লাইব্রেরিতে নয়, ছুটে যায় নীলক্ষেত বা কোনো কোচিং সেন্টারের ভাইয়া-আপার দরবারে!
প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষার্থী সীমিত করতে হবে। আমরা মনে করি, শিক্ষাক্রম এমনভাবে সাজাতে হবে, যেন দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ শেষে শতকরা ৭০ ভাগ তরুণই কর্মজীবনে প্রবেশ করে। সে জন্য, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত হবে মাধ্যমিক স্তর। এই পর্ব পর্যন্ত চালু করতে হবে একমুখি শিক্ষা। সে শিক্ষার মূল ভিত্তি হবে দক্ষতা অর্জন। বিভিন্ন কারিগরি ও প্রাযুক্তিক শিক্ষা ল্যাব করে ৭০ ভাগ তরুণই বিভিন্ন পেশায় প্রবেশ করবে।
বাকি ৩০ ভাগ মেধাবী তরুণরা যাবে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য। সে শিক্ষাও হতে হবে লক্ষ্যাভিমুখি। এ পর্বে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বেছে নেবে তাদের স্বপ্ন ও যোগ্যতানুযায়ী পেশাভিত্তিক শিক্ষা। যেমন: চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিবিদ্যা, শিক্ষকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞানচর্চা ইত্যাদি। এদের মধ্য থেকেই আমরা পাব সেরা দার্শনিক, রাজনীতিক, অর্থশাস্ত্রী, দক্ষ প্রশাসক, বিচারক, কূটনীতিক, পরামর্শক ইত্যাদি।
তার আগে আরও একটি অতি প্রয়োজনীয় কাজ আমাদের করতে হবে। তা হল আগামি ৫০ বছরে জাতীয় ও বৈশ্বিক বাজারের কী ধরনের দক্ষ জনসম্পদ দরকার হবে। তার জন্য আমরা কোন কোন ধরনের কত দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে চাই তার একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রক্ষেপণ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করবে আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করবে। আর সে জন্যই ঢেলে সাজাতে হবে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রণয়ন করতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর কারিকুলাম ও সিলেবাস।
কিন্তু এসব বৈপ্লবিক রূপান্তর কেবল তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা দক্ষ শিক্ষক তৈরি করতে পারব, ভালো বই তৈরি করতে পারব। এ কারিকুলাম হবে প্রাত্যহিক জীবন অভিজ্ঞতায় সিঞ্চিত, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ। কনটেন্ট নয়, পদ্ধতি প্রাধান্য পাবে শিক্ষায়। বর্তমানে প্রচলিত বিষয়বস্তুসর্বস্ব শিক্ষার বদলে কীভাবে জ্ঞান অর্জন করতে হয়, ব্যাখ্যা করতে হয়, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষ ঘটাতে হয় তাই হবে শিক্ষার মূলসূত্র। সব কিছুই হাতে-কলমে করতে হবে, কাজের মাধ্যমে শিখতে হবে। শ্রমের মর্যাদা, ন্যায়বোধ, দেশপ্রেম, মানবকল্যাণ, সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা হবে শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য। সবার উপরে থাকবে মুক্ত চিন্তার অবাধ স্বাধীনতা।
দীর্ঘকাল ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেবাস কমাতে বলছেন, বইয়ের বোঝা কমাতে বলছেন। শিক্ষা বিজ্ঞানীরাও সে দাবী করে আসছেন। কিন্তু আমলানিয়ন্ত্রিত শিক্ষামন্ত্রণালয় সে কথায় কান দিচ্ছে না। সিলেবাস কমাতে হবে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যে কোনো ধরনের কোচিং কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ ও বন্ধ করতে হবে। কোচিং ব্যবসার শাস্তি দিতে হবে মৃত্যুদণ্ড।
এসব লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অর্থ বরাদ্দ সবার আগে সামনে চলে আসবে। বর্তমানে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২ ভাগ। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ৬ভাগ এবং বাজেটের অন্তত ২০ ভাগ বরাদ্দ না করলে কোনো স্বপ্নই সফল হবে না।
গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং অন্য কিছু বিদেশি মাতব্বরি দাতা প্রতিষ্ঠান নানাভাবে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। নানা প্রকল্পের আড়ালে তারা এদেশে শিক্ষায় দুর্নীতি অনুপ্রবিষ্ট করিয়েছে সর্বস্তরে। চটকদার নাম আর পরামর্শের আড়ালে তারা এদেশ থেকে ঋণের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। শিক্ষায় আমলাতন্ত্রের অশুভ অনুপ্রবেশ গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এদের হাতে হাত রেখে বিদেশি স্বার্থবাদীরা আমাদের শিক্ষার সর্বনাশ ঘটাচ্ছে।
শিক্ষাখাতের সকল প্রকল্প এখন আমলাদের দখলে। এর ফলে একই সঙ্গে শিক্ষকদের প্রশাসনিক দক্ষতায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে বসন্তের কোকিলের মত উড়ে এসে জুড়ে বসে আমলারা ব্যাপক দুর্নীতিতে লিপ্ত হচ্ছে। শিক্ষায় গবেষণা প্রায় শূন্যে নেমে গেছে। আমলারা অবকাঠামো উন্নয়নে আগ্রহী, যেখানে দুর্নীতির সুযোগ বেশি। মনে রাখা দরকার, দুনিয়ার সকল সভ্যতাকে ধ্বংসের প্রধান চালিকাশক্তিই ছিল সুবিধাভোগী আমলাতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু তাই আমলাতন্ত্রের লাগাম টেনে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সে লক্ষ্যেই আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।
আমাদের শিক্ষায় আরেকটি প্রধান প্রতিবন্ধক হল শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নে ব্যবস্থার অভাব। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেডাগজি, এন্ডাগজি জ্ঞান অপরিহার্য শর্ত নয় বাংলাদেশে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের যে ব্যবস্থা আছে তা চাহিদার তুলনায় অতি নগন্য। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশে মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বেসরকারি ব্যবস্থা গড়ে তোলার নামে শিক্ষক প্রশিক্ষণের বারোটা বাজিয়েছে। আইন করে এসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। আইনের মারপ্যাচেই তারা আদালতের রায় অর্জন করে।
শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা খুবই জরুরি। সকল স্তরের শিক্ষকের জন্য দেশে-বিদেশে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণার সুযোগ দিতে হবে। দক্ষতাভিত্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রত্যেক শিক্ষক মাথা উঁচু করে, নির্ভয়ে, মুক্ত ও স্বাধীনভাবে জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান বিতরণে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারেন। শিক্ষকদের ওপর দুর্বৃত্তের আক্রমণ, নাজেহাল কার্যকরভাবে বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিও।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড