কুড়িগ্রামঃ জেলার চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের উত্তর খাউরিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিলীন হয়ে যায় নদীগর্ভে। বিদ্যালয়টির নতুন ভবন নির্মাণ হয়নি এখনও। এর মধ্যেই রৌমারী উপজেলায় একটি কক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু করেন তিন শিক্ষক।
সম্মতি না নিয়ে এক উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অন্য উপজেলায় স্থানান্তর এবং গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এ বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে বিপাকে পড়েছেন ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জুলেখা খাতুন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিযুক্ত করা হয়েছে।
অথচ বিদ্যালয় স্থানান্তরে অভিযুক্ত আরেক সহকারী শিক্ষককে দেয়া হয়েছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। অনুমতি না নেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু ছালেহ সরকার এই ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে ২৮ আগস্ট উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু ছালেহ সরকার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, উত্তর খাউরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইনসাব আলীর অবসরজনিত কারণে একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জুলেখা খাতুনকে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্বে অবহেলা, বিদ্যালয় পরিচালনাসহ তার অন্যান্য জ্ঞান কম থাকায় বিদ্যালয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। এমতাবস্থায় বিদ্যালয়ের ও শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান নিশ্চিত করতে জুলেখা খাতুনের পরিবর্তে সিনিয়র শিক্ষক আবু হোসেন মোল্লাকে দায়িত্বভার প্রদান করা হলো।
জানা যায়, ওই বিদ্যালয়ের কর্মরত ৫ সহকারী শিক্ষকের মধ্যে জুলেখা খাতুন ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট, আবু হোসেন মোল্লা ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল, লায়লা খাতুন ২০১৬ সালের ১১ জুলাই, হাসান মাহমুদ ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এবং মুবারক হোসেন ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই পাঁচ শিক্ষকের মধ্যে জুলেখা খাতুনই সবচেয়ে সিনিয়র। তিনি সি ইন এড কোর্স সম্পন্ন করেছেন এবং প্রায় ৬ বছর ধরে ওই বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। জুলেখা খাতুনের চাকরিতে যোগ দেয়ার ১১ বছর পর ওই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন সহকারী শিক্ষক আবু হোসেন মোল্লা। তিনি বিএড কোর্স সম্পন্ন করেছেন।
সম্প্রতি চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের উত্তর খাউরিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদী ভাঙনের কবলে পড়ে। পরে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু হোসেন মোল্লা তার দলবল নিয়ে বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র পার্শ্ববর্তী রৌমারী উপজেলায় নিয়ে যান। সেখানে একটি নিচু জমিতে স্কুল ঘরটি নির্মাণ করা হয়।
তবে এক উপজেলার স্কুল অন্য উপজেলায় নেয়ার ফলে বিপাকে পড়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। বিদ্যালয় স্থানান্তরের বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক জুলেখা খাতুন জেলা শিক্ষা অফিসারকে অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমেও বক্তব্য দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু ছালেহ সরকার। পরে জুলেখা খাতুনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পদ থেকে সরিয়ে আরেক অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক আবু হোসেন মোল্লাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেন তিনি। এ ঘটনাকে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু ছালেহ সরকারের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন স্থানীরা।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু ছালেহ সরকারকে ‘ম্যানেজ’ করে উপজেলার চরাঞ্চলের বেশ কয়েকজন শিক্ষক বিদ্যালয়ে হাজিরা না দিয়েও নিয়মিত বিল-ভাতা উত্তোলন করে আসছেন। বিদ্যালয়ের স্লিপ, রুটিন মেইনটেন্যান্সসহ বিভিন্ন উন্নয়ন বরাদ্দের বিল তুলতে গেলে তাকে কমিশন দিতে হয়। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শিক্ষক আবু হোসেন মোল্লাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি।
দায়িত্ব থেকে অব্যহতির বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষক জুলেখা খাতুন এই বিষয়ে বলেন, ‘আমি এখনও কোনো চিঠি পাইনি। এ বিষয়ে আমাকে অবগত করা হয়নি।’
উত্তর খাউরিয়া চর সরকারি বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহফুজা আকতার বলেন, ‘জুলেখা খাতুনকে তার পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমাকে শিক্ষা অফিসার কিংবা কোনো শিক্ষকও বলেননি। বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পর আমি নিজেই উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। উনি আমাদের উত্তর খাউরিয়া এলাকায় স্কুল পরিচালনার নির্দেশ দেন। তিনিই আবার বিদ্যালয়ের বাকি তিন শিক্ষককে রৌমারী উপজেলায় স্কুল পরিচালনা করার নির্দেশ দেন। শিক্ষা অফিসার তার ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই জুলেখা খাতুনকে পদ থেকে সরিয়ে জুনিয়র শিক্ষককে দায়িত্ব দিলেন। চরাঞ্চলের শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন তিনি।’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার কথা স্বীকার করে আবু হোসেন মোল্লা বলেন, ‘স্কুল বর্তমানে রৌমারী উপজেলার যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। পানি কমে গেলে উপজেলা প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নেবে তা বাস্তবায়ন করা হবে।’
তবে কোনো অর্থের বিনিময়ে তিনি এই পদ নেননি বলে জানান আবু হোসেন মোল্লা।
সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে চিলমারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু ছালেহ বলেন, ‘জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে আবু হোসেন মোল্লাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’
এই বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নবেজ উদ্দিন সরকার বলেন, ‘জুনিয়র শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে আমি জানি না। আর এর কোনো নিয়মও নেই। উপজেলা শিক্ষা অফিসার কোনো অনিয়ম করে থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩০/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়