লুৎফর রহমান হিমেলঃ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিয়ে মাঝেমধ্যেই কথা ওঠে। শোরগোল পড়ে। শোরগোলটা পড়াও দরকার। যেহেতু শিক্ষা একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মনীষীরা যাকে বলেন মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন কারও পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না, তেমনি একটি জাতিও শিক্ষা বা সুশিক্ষা ছাড়া মাথা উঁচু করে বিশ্বসমাজে দাঁড়াতে পারে না। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে সারা বছরই কথা বলা দরকার। জাতির মেরুদণ্ডের যত্ন দরকার। এবং জাতির এই অঙ্গের সমস্যার বিষয়ে বা এর পরিপুষ্টতার বিষয়ে মাঝেমধ্যেই আলোচনার দরকার। এই আলোচনা থেকেই ইতিবাচক ফল আসবে।
এ যুগে সবাই মানেন, শিক্ষিত জাতি একটি সমাজের সম্পদ। কিন্তু সেটা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তখন সে সমাজ কখনো একটি দেশকে এগিয়ে নিতে পারে না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। এই শূন্যতাটা বুঝা যায় আমাদের সমাজের নানা স্তরে বুদ্ধিভিত্তিক ও সাংস্কৃতিকসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার চিত্র দেখে। অথচ একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা গেলে অন্যসব সমস্যার সমাধান করা একেবারেই সহজ হয়ে যায়। কারণ, সুশিক্ষিত নাগরিক অপরাধ করে কম, বা করেই না। গত কয়েকদিন ধরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের সপ্তম শ্রেণির নতুন বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু অনুচ্ছেদের ‘কুম্ভিলকবৃত্তি’ নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটিকেও বড় কোনো ঘটনা হিসেবে মনে করছি না। এরচেয়েও বড় আলোচ্য বিষয় আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিয়ে।
২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী জাতীয়ভাবে এখন এ দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ। ইউনিসেফের তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালে আমরা যখন স্বাধীনতা লাভ করি, তখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। সেই হিসাবে আমরা এখন শিক্ষায় বিরাট এক অগ্রগতি লাভ করেছি। এই যে শিক্ষার হারের উচ্চগতি, তারপরও সমাজের নানা স্তরে দেখা যায় নৈতিকতাবোধের বিপুল ঘাটতি। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ১৬.৮ শতাংশ শিক্ষিত নাগরিকের একটি সমাজ সেই সময় এদেশ স্বাধীন করার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিতে কার্পণ্য করেনি। আর এখন ৭৪ শতাংশ শিক্ষিত মানুষের সমাজে এমন একটি সংগ্রাম দরকার পড়লে কতজনকে পাওয়া যাবে? সংগ্রামের কথা তো দূরে থাক, এখন ভালো কাজে রাজি হওয়ার লোকই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই যে দেশে শিক্ষার হার আমরা বাড়িয়ে তুলেছি, জিপিএ ৫, স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডির ছড়াছড়ি; কিন্তু সুশিক্ষিত মানুষ সেভাবে দেখতে পাচ্ছি না। বরং মানুষ এখন যত শিক্ষিত হচ্ছে, কীভাবে যেন ততই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠছে! মেধাবী নয়, তারা হয়ে উঠছে একেক জন চালাক-চতুর। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। গুণগত মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত হলে এ প্রজন্মের নাগরিকরা নৈতিকভাবে শক্তিশালী হতো। দেশে অন্যায়-অপরাধ কমত। কিন্তু সে-রকম দৃশ্য তো দেখা যাচ্ছে না। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, নিশ্চয়ই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট আছে, সমস্যা আছে। আর চারদিকে চোখ মেলে তাকালেই এই সংকটের তীব্রতা আমরা আঁচ করতে পারি।
মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জিনিসটাই এখন উঠে গেছে। পরস্পরকে ঠকানোর এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে মানুষ। এদের বেশিরভাগই কাগজে-কলমে সনদধারী, শিক্ষিত। যারা যত বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠছে, তারা যেন তত বেশি চালাক হয়ে উঠছে। প্রতারণার ষোলোকলা রপ্ত করাই যেন শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য হয়ে উঠছে। দুর্নীতি করার জন্য যে শক্তি বা যোগ্যতা দরকার, সেটিই যেন তারা অর্জন করতে শিক্ষা নামের অস্ত্রের দ্বারস্থ হচ্ছে। অথচ আগের কালের মানুষ পড়তে জানত না, লিখতে জানত না। তবু মানুষের মনে ছিল না প্রতারণার এত ফন্দিফিকির। তারা কথা দিলে সে কথা রাখতে জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতেন। তারা কঠোর নৈতিকতা মেনে চলতেন। তারা বলতেন, ওয়ার্ড ইজ ওয়ার্ড! জবান জবানই। আর এখনকার শিক্ষিত মানুষজন লিখিত দিয়েও সেটি অস্বীকার করে বসে!
এই যে নৈতিকতার অধঃপতন, এই যে আদর্শহীনতা, এখান থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে পারছে না বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং গবেষকরা বলছেন, আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক এখনকার বিশ্বে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত জ্ঞান সৃষ্টি ও টিকে থাকার কোনো উপায় খোঁজার সহায়ক নয়। শৈশব থেকেই অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে থাকায় একসময় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই শিক্ষার যথোপযুক্ত পরিবেশও। এমন অবস্থার মধ্যেই নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় কাজের সুযোগ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠছে একেকটি হতাশা সৃষ্টির কারখানা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন করে কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় সংকট হলো ত্রুটিপূর্ণ সিলেবাস। পড়ার বিষয়বস্তু ঠিক না রেখেই পড়ানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ফলে শিক্ষার্থীরা কী পড়ে, কেন পড়ে সেটাই বুঝে উঠতে পারে না তারা। শুধু পড়ার প্রয়োজন তা-ই পড়ছে তারা। এ দেশে শিক্ষা মানেই শুধু বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা, পাঠ্যবই মুখস্থ করা বা পরীক্ষার খাতায় জিপিএ ৫ অর্জন করা। অথচ শিক্ষা মানে হলো অর্জন আর প্রয়োগের বিষয়। যেটার ধারেকাছে নেই আমরা। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষার মান একদম তলানিতে। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং উদ্ভাবন এ তিন দিক দিয়েই আমরা অনেক পিছিয়ে। বিশ্বের উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো যেখানে বিভিন্ন গবেষণা এবং নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে ব্যস্ত, তখন আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত থাকতে হয় জীবন-জীবিকা নিয়ে। তারপরও শিক্ষা শেষে মেলে না কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা।
ভর্তির পরপরই প্রতিষ্ঠান কর্র্তৃক শিক্ষার্থীদের মনে শিক্ষার আগ্রহের বীজটুকু বপন করানো জরুরি। বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনায় নির্দিষ্ট বিষয়াবলির প্রয়োগ ঘটানো জরুরি। পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত নৈতিক, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এবং ক্যারিয়ারবিষয়ক সেশন নেওয়া উচিত। কিন্তু সেসবের বালাই নেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। আমাদের দেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবাদাতাদের আচরণ, ভদ্রতাবোধ, সততা, কাজের দক্ষতা ও আন্তরিকতার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব বিবেচনা করলে দেখা যায়; আমাদের এই কর্মীরা একেবারেই অপেশাদার। সেবাগ্রহীতারাও একই রকম পরিচয়ের স্বাক্ষর রাখেন। কারণ আমরা সবাই একই শিক্ষাব্যবস্থার ফসল। শুধু চাকরিজীবী নন, প্রায় সব পেশাজীবীর মধ্যেই এ ঘাটতি রয়েছে। নিউইয়র্কভিত্তিক সিইও-ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন ২০২০ সালে সেরা শিক্ষাপদ্ধতির দেশগুলোর একটা তালিকা তৈরি করেছিল। ওই তালিকার ৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই! অথচ ওই তালিকায় মিয়ানমার, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত স্থান পেয়েছে। এতে বোঝা যায়, পর্যাপ্ত সুনাগরিক তৈরির উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি এ দেশে।
শিক্ষার্থীরাই জাতির ভবিষ্যৎ। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে কোনো কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি না করলে সেটি জাতির ভবিষ্যৎও তৈরি করবে না। অতিরিক্ত, অযৌক্তিক, অবাঞ্ছিত সিলেবাসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া জিপিএর লোভ থেকে বের হতে হবে। শিক্ষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। যেটি এ দেশে হারহামেশা ঘটছে। এখানে শিক্ষার্থীদের নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাধ্যগতভাবে গতানুগতিক ভালো ফলাফল এলেও এই শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন কিংবা রাষ্ট্রের কী কাজে লাগবে তা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই জানে না। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষায় তৈরি হয়েছে চাকরির বাজারের অনিশ্চয়তা। যার দরুণ ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার্থীরা আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে।
চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে, সারা দেশে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অন্তত ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর দায় আমরা এড়াতে পারি না। এ দায় যারা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদেরই। শুধু আত্মহনন নয়, গোটা জাতির পতন ঠেকাতে এখনই শিক্ষাসংকটের সমাধান করতে উদ্যোগী হতে হবে আমাদের। না হয় তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নানা সম্ভাবনা থাকার পরও ছিটকে পড়তে হবে আমাদের।
লেখক: সাংবাদিক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৩/০২/২৩