শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘অভিভাবকত্ব’ কাদের হাতে?

তাসলিমা তামান্না।।

কয়েক মাস আগে হঠাৎ রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ-সংশ্লিষ্ট দুটি ভিডিও ‘ভাইরাল’ হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদের সঙ্গে এক ছাত্রীর ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক’ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ভিডিও ফুটেজে। এর আগেও নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে; কিন্তু কোনো ছাত্রীর সঙ্গে অসংগত সম্পর্কের ভিডিও প্রকাশ পায়নি।

পরিচালনা পর্ষদের প্রবীণ ও প্রভাবশালী ওই সদস্য যদিও সম্পর্কটিকে ‘প্রেম’ আখ্যা দিতে চেয়েছেন; ছাত্রীর বয়স ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় এটা জিম্মি করে যৌন নির্যাতন ছাড়া কিছু নয়। আরও বিস্ময়ের বিষয়, প্রতিষ্ঠানটির খোদ অধ্যক্ষ ফৌজিয়া রাশিদীর বিরুদ্ধেও এই অনৈতিকতায় সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে। মুশতাক আহমেদের নরসিংদীর বাগানবাড়িতে ছাত্রীদের নিয়ে ‘শিক্ষা সফর’-এ যেতেন তিনি। স্বভাবতই এ ঘটনায় ফুঁসে উঠেছিল অভিভাবক মহল। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও অধ্যক্ষ রয়ে গিয়েছিলেন বহাল তবিয়তে। প্রশ্ন জাগে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ‘অভিভাবকত্ব’ আসলে কাদের হাতে?
 
মন্দের ভালো, শেষ পর্যন্ত ওই ঘটনায় ‘ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ ও ধর্ষণে সহায়তা’র অভিযোগে ‘দাতা সদস্য’ খন্দকার মুশতাক আহমেদ এবং অধ্যক্ষ ফৌজিয়া রাশিদীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে। মামলায় খন্দকার মুশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে ওই ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে। আর অধ্যক্ষ ফৌজিয়া রাশিদীর বিরুদ্ধে মুশতাককে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়। আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে মামলাটি নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
 
এর আগে ২০১১ সালে রাজধানীর আরেক নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বাংলার শিক্ষক পরিমল জয়ধরের বিরুদ্ধে ওই স্কুলের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ওই শিক্ষককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
 
আমাদের সমাজে মা-বাবার পরেই শিক্ষকের স্থান। শিক্ষকের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনা পরিষদ সদস্যদের কথাও আসবে। তাদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। এখন তারাই যদি রক্ষকের বদলে ভক্ষকের ভূমিকায় নামেন, তাহলে আমাদের সন্তানরা কার কাছে নিরাপদ?
 
নিঃসন্দেহে অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়া কিংবা অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া ভালো খবর। কিন্তু প্রশ্ন হলো– শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে?
 
খোদ রাজধানীর নামি স্কুলগুলোতেই যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না জানি এ ধরনের কত ঘটনাই ঘটছে! এর মধ্যে কিছু প্রকাশ্যে আসে, কিছু ঘটনা লোকলজ্জার ভয়ে, কিছু ঘটনা ক্ষমতাধরদের চাপে ধামাচাপা পড়ে যায়।
 
কেন এমন হয়? প্রশ্নটি আসলে গোড়ার। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে শিক্ষানুরাগীদের ঠাঁই হচ্ছে না। সেগুলো স্থানীয় সংসদ সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে। এদের দাপটে কোথাও কোথাও শিক্ষক পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আবার কোথাও কোথাও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ, প্রতিষ্ঠানপ্রধান থেকে কর্মচারী-কর্মকর্তা সবাই মিলে-ঝিলে অনিয়ম, দুর্নীতি করে যাচ্ছেন।
 
এ প্রসঙ্গে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০২২ সালে নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে জুতার মালা পরিয়ে চরম অপদস্থ করা হয়। পরে দেখা যায়, এমন অভিযোগ তোলার নেপথ্যে রয়েছেন কলেজটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি। একই বছর জুন মাসে সাভারের আশুলিয়ায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে এক শিক্ষার্থী। পরে দেখা যায়, স্কুলের পরিচালনা কমিটিতে থাকা তার আত্মীয় ও অপর এক শিক্ষক শিক্ষার্থীকে প্ররোচিত করেছিলেন।
 
দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র নির্বাচনে বছরের পর বছর সভাপতির পদ দখল করে থাকছেন। নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্য করছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস, অতিরিক্ত ফি আদায়, কোচিং বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ প্রায়ই দেখা যায়।
 
আরেকটা ভয়ংকর বিষয় হলো, শিক্ষার্থীরাও জানতে পারছেন তাদের শিক্ষকরা টাকার বিনিময়ে অর্থাৎ তার কাছে প্রাইভেট পড়ার কারণে পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেন। ফেল করলেও পাস করিয়ে দেন। কখনও কখনও প্রশ্ন ফাঁস করে দেন। এতে তারাও আর সততা ও সুনীতির শিক্ষা পাচ্ছে না। বরং দুর্নীতির অংশ হয়ে যাচ্ছে অনেকে।
 
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালীদের অনৈতিকতা ও দুর্নীতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে, সেটা দেখা গিয়েছিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায়। সেখানকার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনার মূল হোতা ও যৌন নিপীড়নকারী অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন।
 
দুর্ভাগ্যের বিষয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটে চলা এসব দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কর্তাব্যক্তিরা রহস্যজনকভাবেই নীরব থাকেন। কোনো বড় অঘটন ঘটার পরই শুধু খানিকটা সক্রিয় হন; তদন্ত কমিটি করেন।
 
আমার মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা কমিটির গঠন, কাঠামো ও পদ্ধতি নিয়েই নতুন করে ভাবা দরকার। যদি গণতান্ত্রিকভাবে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা যায়, তাহলেই অর্ধেক সমস্যা মিটে যাবে। কারণ নির্বাচনের প্রয়োজনেই কমিটি বা পর্ষদ সদস্যরা অভিভাবক বা শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন। তখন জবাবদিহি প্রতিষ্ঠাও সহজ হবে। বাকি অর্ধেক দায়িত্ব শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর। তাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত তদারকি ও নজদারি; অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা বজায় থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রক্ষকরা ভক্ষক হতে গিয়ে দু’বার ভাববেন।
 
শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ রক্ষায় সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগ ও সম্পৃক্ততা থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে না। ক্ষমতার দাপটে কেউ উড়ে এসে ‘অভিভাবক’ হিসেবে জুড়ে বসবে না।
 
তাসলিমা তামান্না: জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, সমকাল