শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান শিক্ষা সংকোচনের ফল কী হবে

মাছুম বিল্লাহঃ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে শিক্ষার্থীরা অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই হাতে পেতে যাচ্ছে। নতুন কারিকুলামের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হচ্ছে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা মানবিক, বিজ্ঞান কিংবা ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়ত, সেটি আর থাকছে না। সব শিক্ষার্থীকেই বাধ্যতামূলকভাবে সাধারণ ১০টি বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। বিষয়টি একমুখী শিক্ষা নামেও পরিচিত।

এটি ২০০৪-০৫ সালেও তৎকালীন সরকার চালু করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় ও শিক্ষাবিদদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছিল। নতুন কারিকুলাম শুরুর আগে কভিডকালীন ও কভিড শুরুর আগেও এনসিটিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফরমালি ও ইনফরমালি কয়েকবার আলোচনা ও কথাবার্তা হয়েছে। কেউ কেউ মত জানতে চেয়েছিলেন বিষয়টি নিয়ে। আমি বলেছিলাম একমুখী শিক্ষা কিংবা নবম শ্রেণি থেকে নো-গ্রুপ বিভাজন বিষয়টি কিন্তু সেই ১৯৬২ সালের।

আমরা এত বছর পরে আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাব এই বিশেষায়নের যুগে! এনসিটিরিব একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বললেন, ‘আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শেখাচ্ছি আর তারা বুয়েট-চুয়েট থেকে পাস করে সার্ভ করছে আমেরিকাকে।’ আমি তখন ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কাজ করি। আমি তখনই বলেছিলাম এটি কেমন কথা? আমাদের শিক্ষার্থীরা বুয়েট থেকে পাস করে বিদেশে চলে যায়, তাই আমরা তাদের বিজ্ঞান শিক্ষা নিরুৎসাহ করব? তাঁরা যেহেতু বিষয়টি চালু করার ক্ষমতা রাখেন, বিষয়টি তাঁরা চালু করেছেনই। কিন্তু এর গভীরে ঢুকলে দেখা যায় যে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের বিভাগভিত্তিক বিজ্ঞান বিষয়ে অন্তত ৪০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো।

অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়টি তারা মোটামুটি জানার সুযোগ পেত। রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি উচ্চতর গণিত, জীববিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ইত্যাদির মধ্য থেকে যেকোনো একটিকে বাধ্যতামূলক ও একটি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে বেছে নিত শিক্ষার্থীরা।
নতুন কারিকুলামে বিষয়গুলোকে একীভূত করে যা দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এখন মাত্র ১০০ নম্বরের বিজ্ঞান পড়বে। বিজ্ঞানের এই যুগে, বিশেষায়ন ও বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের একেবারেই সংকুচিত জ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করবে! কিছু কিছু শিক্ষাবিদ এটি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। কিন্তু যখন এই কারিকুলাম চালু হয় তখন কিন্তু তারা অনেকেই সায় দিয়েছিলেন।

আমরা বলেছিলাম এত বড় পরিবর্তন একলাফে আনা ঠিক হবে না। মুখে বলছি শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানমুখী হবে আর বিজ্ঞান পড়াব না, বিজ্ঞানের সব দিক সংকুচিত করে ফেলব! এটি বিপরীতমুখী কথা হলো না? এমনিতেই আমাদের শিশুরা বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষায় অনাগ্রহী শিক্ষার্থীরা। কারণ বিজ্ঞানকে আকর্ষণীয়ভাবে, ভালো কনসেপ্ট দিয়ে পড়ানোর মতো শিক্ষকস্বল্পতা, বিজ্ঞানাগারের অভাব, যন্ত্রপাতির অভাব। অথচ বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞান শিক্ষাকে আমরা কতভাবে উৎসাহিত করতে পারি সেটি নিয়ে পদ্ধতি বের করা প্রয়োজন। সেটি না করে আমরা নতুন কারিকুলাম আনন্দময় করার দোহাই দিয়ে বিজ্ঞানকে সরিয়ে ফেলেছি। এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমানে যারা মানবিক বিভাগে পড়ে তারা বিজ্ঞান জানে না, যারা বিজ্ঞান পড়ে তারা সাহিত্য জানে না, যারা ব্যবসা শিক্ষায় পড়ে তারা ইতিহাস জানে না। এবার নতুন কারিকুলামে সবাই সবটা জানবে।’
এটিও একটি অবাস্তব কথা! সবাই সবটা জানবে না, জোর করে জানানোও যাবে না। বিজ্ঞানের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে তারা বিজ্ঞান পড়বে। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী সাহিত্য নিজ ইচ্ছায় পড়ে। অনেক মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী মেডিক্যাল পড়ার চাপের মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের বহু বই পড়ে ফেলে। অনেক ইঞ্জিনিয়ার সাহিত্যের অনেক বই পড়ে। এটি হচ্ছে যাদের যেদিকে আগ্রহ আছে এবং যারা পড়ে ডাইজেস্ট করতে পারে, তারা সেসব পড়বেই। জোর করে সবাইকে সব পড়ানোর চেষ্টা অযৌক্তিক। এই কারিকুলামে আমরা যা করছি তা হচ্ছে যারা বিজ্ঞান পড়তে ভালোবাসবে না বা আগ্রহ নেই বা পড়ে বুঝবে না তাদেরও বিজ্ঞান পড়াব। যারা বিজ্ঞান বিস্তারিতভাবে পড়তে আগ্রহী তাদের আমরা ইচ্ছে করেই দমিয়ে রাখব। বিষয়টি কেমন হলো? আমরা শুধু বলতেই পারি, এ ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে? কিন্তু শিক্ষার্থীদের, ভবিষ্যৎ বংশধরদের যে ক্ষতিটা হচ্ছে এবং গভীর ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে তার দায়ভার কে বা কারা নেবে?

১৯৯০ সালের দিকে তাকালে দেখা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ১১টি বিষয়ে মোট এক হাজার নম্বরের পরীক্ষা হতো। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য মোট নম্বর ছিল ৩০০, যা মোট নম্বরের ৩০ শতাংশ। ২০০০ সালে এসএসসিতে বিষয় ছিল ১১টি, নম্বর ছিল ১১০০। তার মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নম্বর ছিল ৪০০। ওই সময়ে মোট নম্বরের ৩৬ শতাংশ ছিল বিজ্ঞানে। ২০১৭ সালে মোট বিষয় ছিল ১৪টি। এর মধ্যে বিজ্ঞানের জন্য মোট নম্বর ছিল ৪০০। অর্থাৎ মোট নম্বরের ৩১ শতাংশ। নুতন কারিকুলামে নবম-দশম শ্রেণিতে মোট বিষয় রাখা হয়েছে ১০টি। ১০০০ নম্বরের পরীক্ষায় বিজ্ঞানে থাকছে ১০০ নম্বর, অর্থাৎ মোট নম্বরের ১০ শতাংশ। এটি বিজ্ঞান শিক্ষা সংকোচনের নমুনা নয় কি?

নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন মানে হচ্ছে উচ্চতর পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো কমবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এত দিন ধরে নবম-দশম শ্রেণিতে পৃথকভাবে তুলনামূলক বড় পরিসরে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতের মতো বিষয়গুলোয় পড়াশোনা করে আসত। মাধ্যমিকের পর যত ওপরের স্তরে যাবে, বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার তত কমে যেতে পারে। কাজেই মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সংকোচন করার প্রভাব অনেক বেশি এবং সুদূরপ্রসারী।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থীর হার ছিল যথাক্রমে ৩১ শতাংশ, ৩১.৯৪, ৩০.৯২, ২৮.১৯ ও ৩১.৯৩ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এ হার অনেকখানি কমে গেছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল যথাক্রমে ২২.২৯ শতাংশ, ২৩.৩৫ শতাংশ, ২৩.৪২ শতাংশ, ২২.৫০ শতাংশ ও ২৪.৫৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে স্নাতক পর্যায়ের চূড়ান্ত পরীক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোর অংশ নেওয়া পরীক্ষার্থীর হার ছিল ১৭.৪৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ১৬.০৬ শতাংশ। ২০২০ সালে এর হার দাঁড়ায় ২৩.২৮ শতাংশ। যদিও কভিডের কারণে এটি হয়েছিল, কিন্তু চিত্র তো বলে দিচ্ছে যে বিজ্ঞান শিক্ষার কী হাল আমাদের দেশে!

এসব বিষয়ে এনসিটিবি বলছে, এ শিক্ষাক্রমের নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়ের অধীনে অনুপাত ও পরিমাণ, সিস্টেম, সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ সজীব এবং বস্তুগুলোর গঠন ও আচরণ, পদার্থের গঠন ও আচরণ, বস্তু ও শক্তির মিথস্ক্রিয়া, স্থিতি ও পরিবর্তন, জীববিজ্ঞান এবং পৃথিবী ও মহাকশবিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। শিক্ষার্থীদের এসব বিষয় এমনভাবে পড়ানো হবে, যাতে তারা বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা অর্জন করে, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় এবং তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।’ এটি তো সেই আশার কথা, ভাবনার কথা কিন্তু বাস্তবতা কী? সব শিক্ষার্থীই কি এগুলো বোঝার পর্যায় থাকবে যে সবার জন্যই বিজ্ঞানের একই বিষয়, এমনভাবে পড়ানো হবে। কে পড়াবেন এমনভাবে? সব বিদ্যালয়ে কি এমন বিজ্ঞান শিক্ষক আছেন?

আমাদের কাছাকাছি দেশ চীনে ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সে জুনিয়র মাধ্যমিক স্কুল সম্পন্ন করতে হয়, যেখানে শিক্ষার্থীদের গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের মতো বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো তুলনামূলক বিস্তারিতভাবে শেখানো হয়। ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দে অধ্যয়ন করতে পারে এবং তারা সে অনুযায়ী বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের যেকোনো একটি বেছে নিতে পারে। এভাবে বিশ্বের প্রযুক্তিনির্ভর অনেক দেশেই মাধ্যমিক পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয় নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে এবং সমন্বিত বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে পৃথকভাবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিত পড়ানো হয়। কিন্তু আমাদের হচ্ছে কী?

২০২৩ সাল কেটে গেল। নভেম্বরে শিক্ষার্থীরা তাদের ফল পাবে, কিন্তু পুরো বছরে লিখিত কোনো পরীক্ষাই হলো না, সবটাই শিক্ষকরা বুঝে আর না বুঝে সার্কেল, চতুর্ভুজ আর পিরামিড দিয়েছেন। কোনো বিষয় কী জানল সেটির প্রকাশ করার জনপ্রিয় মাধ্যমে হচ্ছে লিখে প্রকাশ করা। লিখে প্রকাশ করা মানে ভাষাজ্ঞান দেখা, ধারণা কতটা পেল সেটি দেখা, একটি বিষয় গুছিয়ে কতটা লিখতে পারে একজন শিক্ষার্থী ইত্যাদি দেখা, কিভাবে যুক্তি, তর্ক, উপস্থাপন এবং মনের ভাব সুন্দরভাবে প্রকাশ করা—এগুলোরই কাঙ্ক্ষিত মাধ্যম হচ্ছে লেখা। দৈহিক ভাষা, মুখের ভাষারও একটি অংশ থাকবে, কিন্তু সেটি সব নয়। এখন দেখা যাচ্ছে আসল বিষয়কে আমরা সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যটিকে বেশি জোর দিচ্ছি। এতে কি আমাদের জাতীয় মূল কারিকুলামে ভবিষ্যৎ বংশধরদের যেভাবে বেড়ে ওঠার কথা সেটি অর্জিত হবে?

লেখক : শিক্ষা গবেষক ও সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৬/১০/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়