ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল: অবশেষে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হেমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি বরাবরই আমার কাছে ছিলো আকর্ষণীয়। কিন্তু নানা কারণেই মনে হতো, এতো সোনার হরিণ। সবার কপালে এসব জোটে না। মেনে নিয়েছিলাম এসব আমার জন্য নয়। আমি ছা-পোষা, সাধারণ। আমি এভারেজ। আমি কেউকেটা নই। উচ্চতর পড়াশোনার সুবাদে ছাত্র হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে দিলাম অনেকগুলো বছর। তারপর পাস করে একদিন মনে হলো, এখানেই শিক্ষক হিসেবে এলে মন্দ হয় না। ২০১৯ সালে আবেদন লিখেও শেষ অবধি জমা দিইনি। ২০২০ সালে আবার দিলাম। নির্বাচিত হইনি। ভাইভা বোর্ডেই একজন পরীক্ষক বললেন, ‘তুমি তো মাত্র পাস করেছ।’ তারপর ২০২২ সালে আবার এপ্লাই করলাম। ১৬ অক্টোবরর নিয়োগপত্র পেলাম।
একটা আনন্দঘন ও আবেগঘন দিন ছিলো আমাদের জন্য। যার কারণে এই দিনটি এতোটা আনন্দমুখর হয়েছে তিনি হলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভিসি অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ স্যার৷ স্যারের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। শুরুতে ‘অবশেষে’ বললাম এই কারণে যে, এই পথটি মসৃণ ছিলো না৷ বাধা ছিলো, প্রতিবন্ধকতা ছিলো। যতো বাধা পাচ্ছিলাম ততোই জেদ চেপে যাচ্ছিলো। শেষে বেরিয়ে এলাম আমার নিজস্ব গন্ডি ছেড়ে৷একটা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধই ছিলো আসলে। এই যুদ্ধে আমার শক্তি যিনি ছিলেন তিনি হলেন Sabuj Shahidullah ভাই। মেডিকেল সেক্টরে আমি এই মানুষটাকে গুরু বলে মানি। সেই ২০০৯ সাল থেকে উনাকে মুগ্ধ হয়ে দেখি। একজন মানুষ সবদিকে কতোটা ব্যালেন্সড হতে পারেন। Rasul Amin শিপন ভাই আর Md Rassell ভাইয়ের কথা বলতে হবে আলাদা করে। খুব অল্প সময়ে মানুষগুলো আমাকে আপন করে নিলেন। গত ছয় মাসে তারা আমার পাশে ছিলেন সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে ভাইয়ের মতো, পরম বন্ধুর মতো। আমি যেন তাঁদের কথা কখনো ভুলে না যাই। আমার বন্ধু Mohammad Faisal। তার আন্তরিক অভিব্যক্তি আমাকে শক্তি দিয়েছে। যখন এমডি কোর্সের ছাত্র ছিলাম তখন থেকেই অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ স্যার আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। দেখা হলেই বলতেন ‘আমি তোমার গান খুব পছন্দ করি।’ একবার ওএসবির অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলেন গান গাইতে। স্যার তখন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট সম্ভবত। গান শেষে নিজে ছুটে এসে বললেন, ‘তুমি কিন্তু দারুণ গেয়েছ’।
২০১৯ সালের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে থিসিসের জন্য যখন এওয়ার্ড পেলাম স্যার আমাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘এখানে সার্কুলার হলে ঢুকে যেও। তোমার মতো লোক দরকার।’ তখন তিনি প্রোভিসি (শিক্ষা)। কীভাবে যেন ইচ্ছাটা ঢুকিয়ে দিলেন তিনি আমার মধ্যে। দারুণ ইন্সপিরেশন ছিলো সেটা। ভাবিনি উনার হাত দিয়েই একদিন নিয়োগপত্র পাবো। সমস্যা হচ্ছে এখন ভিসি হয়ে যাবার পর স্যারকে নিয়ে সেসব স্মৃতিচারণ খুব ক্লিশে হয়ে যায়। যেমন আমাদের কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস জীবনের নায়ক, আমার ছাত্র জীবনের সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক, সদ্য পোস্ট গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করা তরুণ শিক্ষক খুরশিদ স্যারকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই কোথায় যেন বাধে। যে মানুষটা আমার গানের রুচি তৈরি করে দিয়েছিলেন, নিজে হাতে অসংখ্য ক্যাসেট আর সিডি রেকর্ড করে দিয়েছিলেন, জীবনে প্রথম আমাকে গীতবিতান কিনে দিয়েছিলেন, অনেক ব্যাস্ততার পরও আমার প্রথম সিডি উদবোধন করে দিয়েছিলেন সেই একান্ত আপন মানুষটাকে নিয়ে আমি ফেসবুকে তেমন কিছুই লিখতে পারি না। ডিজি স্যারকে নিয়ে এসব লেখা আসলে উচিতও নয়। তাই এখানেই থামছি।
ঢাকায় আমার জীবন শুরু করেছিলাম পরিবারের ছয়জন মানুষকে নিয়ে। এখন চারজন। দুজন চলে গেলেন একে একে। আজ আব্বাকে খুব মনে পড়ছে। আম্মাকেও। খুব করুণ আর গভীরতম বেদনার মতো মনে পড়ছে৷ ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় ক্লিনিকে আমার জুনিয়র ডক্টররা বলছিলো, ‘স্যার আপনার অনুভূতি কেমন?’ আমার ইচ্ছে হয়েছিলো বলি, ‘বাবা মা চলে যাবার পর জীবনের কোনো আনন্দই আর আগের মতো স্বাদের হয় না।’ তবু আমি জীবনবাদী মানুষ। আনন্দই আমার জীবনের মূল শক্তি। আজ তবে আনন্দই হোক। আমার পরিবারের সকল সদস্যর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। শেষে আসল কথাটা বলি। আমি আসলে ‘পিউর শাহবাগী’। শাহবাগ আমাকে ছাড়ে না। শাহবাগ আমার মায়া কাটাতে পারলোনা। সেই এমফিল কোর্সে ঢুকেছিলাম ২০০৮ সালে৷ এরপর থেকে ঘুরে ফিরে শাহবাগেই আটকে রইলাম।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৭/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়