ড. মো. রফিকুল ইসলামঃ শিক্ষকতাকে একটি মহৎ ও মানবিক পেশা হিসাবে গণ্য করা হলেও শিক্ষণ প্রক্রিয়া অনেক জটিল কাজ। শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়, বরং সমাজ ও দেশের এক ধরনের সেবা। একজন সফল শিক্ষক হওয়ার জন্য কেবল বিষয়সংশ্লিষ্ট জ্ঞান ও শেখানো পদ্ধতিবিষয়ক জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে বিষয়গত জ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও জানা দরকার। শিক্ষকের পেশাগত শিক্ষা এমন হবে, যা শুধু শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও শ্রেণি ব্যবস্থাপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তার পড়াশোনার পরিধি হবে ব্যাপক। আর আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে আগ্রহ থাকবে অফুরন্ত। সেই সঙ্গে চিন্তা ও বিবেচনাবোধ থাকবে সীমাহীন। শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের জানতে ও বুঝতে হবে এবং তার সব কর্মকাণ্ডে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিফলিত হবে। তবে উন্নত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকের, আর দক্ষ শিক্ষক তৈরি করার জন্য দরকার উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা।
Advertisement
প্রাচ্যদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সবসময়ই গুরু-শিষ্যের মতো ছিল। প্রাচীন ভারতের নালন্দা থেকে শুরু করে সোমপুর বৌদ্ধবিহার ও শালবন বৌদ্ধবিহার এবং নিকট অতীতের পণ্ডিত সমাজ থেকে শুরু করে মাদ্রাসাভিত্তিক মৌলভী-ছাত্রের সম্পর্ক ও গুরু-শিষ্যের পরস্পরকে মনে করিয়ে দেয়। যেখানে একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে একাডেমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে নীতি-আদর্শ শিষ্টাচারসহ ব্যবহারিক জীবনের সব ধরনের দিকনির্দেশনায় দীক্ষিত করেন। আর ছাত্র তার গুরুর সেই শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করে ভবিষ্যৎ জীবনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা শিক্ষকের অনুপ্রেরণা ও রোল মডেল অনুসরণ করেন। যেহেতু শিক্ষক এমন একজন ব্যক্তি যিনি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেন, সেহেতু শিক্ষক স্কুল ও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রদান করেন। শিক্ষকতা পেশা সারা বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত চাকরিগুলোর মধ্যে একটি। তাই শিক্ষকদের সম্মানার্থে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস পালিত হয়। এ দিবসটি শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পালন করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার জন্য এবং তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার নিয়ে তৎকালীন সরকার ২০০৩ সালের ১৯ জানুয়ারি থেকে জাতীয় শিক্ষক দিবস চালু করে। ওই সময় থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৯ জানুয়ারি জাতীয় শিক্ষক দিবস পালন করা হয়।
কোনো সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হতে চাইলে অবশ্যই স্নাতক/স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। বিশেষ করে জ্ঞান প্রসারের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রফেশনাল কোর্স বা ডিগ্রি অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে অবাধ সুযোগ রয়েছে। যেমন-এমফিল, পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরেট ডিগ্রি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে যারা প্রতিভাবান, শিক্ষিত, শান্ত-নম্র ও দেবতাসুলভ ব্যক্তি, তারাই শিক্ষকদের চরিত্র গঠনে বিশাল ভূমিকা রাখেন। একজন শিক্ষকের ভূমিকা ও দায়িত্ব অফুরন্ত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়াই মুখ্য। তারা আমাদের জীবনকে স্পর্শ করে আর আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে। শিক্ষকদের অর্জিত বিদ্যা শিক্ষার্থীর মধ্যে কাক্সিক্ষত মান অনুযায়ী সঞ্চারিত করা খুব সহজ কথা নয়। শিক্ষকের শিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হলো টেকসই জ্ঞান ও অনুসন্ধান। এসবের প্রতিফলন ঘটে চর্চার মাধ্যমে। অন্যদিকে শিক্ষকতা পেশার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক দক্ষতা আর বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের শিক্ষা। এ কার্যক্রমে বিষয়, জ্ঞান, শেখানোর পদ্ধতি, শিক্ষার বিভিন্ন দর্শন, মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, শিক্ষার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমি, আর্থ-সামজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষার অনুশীলন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে।
শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিসর অত্যন্ত ব্যাপক। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আর্নল্ড জোহান্স সমরফিল্ড নতুন নতুন ধারণা দিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন। তিনি ৮৪ বার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও শেষ পর্যন্ত পুরস্কার পাননি। সমরফিল্ড একজন শিক্ষক ছিলেন। নিজে নোবেল পুরস্কার পাননি বলে হাল ছেড়ে দেননি, বরং তিনি তার ছাত্রদের এমনভাবে গড়ে তুলেছিলেন যে তার ছাত্ররা নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি যত না বড় বিজ্ঞানী ছিলেন, তার চেয়ে বড় ছিলেন শিক্ষক হিসাবে। একজন শিক্ষকের স্বপ্ন তার ছাত্ররা তাকে একদিন অতিক্রম করবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজে এ ধরনের শিক্ষকের বড়ই অভাব। তবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং সমাজ উন্নয়নে সব শিক্ষকেরই ভূমিকা থাকবে এমনটি নয়। বিশেষ করে শিক্ষকের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও সুনাম শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায় বিদ্যমান থাকে না। একজন শিক্ষক আদর্শ মানবসৃষ্টির শৈল্পিক কারিগরও বটে এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি, নির্দেশনা ও আদর্শ-জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হয়। তাই বলা হয়, ব্যক্তি মানব এখানে অর্থহীন। কিন্তু ব্যক্তি শিক্ষক সবার শ্রদ্ধার ও সম্মানের পাত্র। তাছাড়া শিক্ষক সমাজ সর্বজনীন, কল্যাণকর ও প্রভাবশালী সচেতন প্রতিনিধি। এক্ষেত্রে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বদান, সংগঠিত মনোভাব সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। শিক্ষককে সমাজে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে সামাজিকতা, জনসচেতনতা সৃষ্টি, সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বদান, জনমত গঠন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, সামাজিক বিবাদ-মীমাংসা, অপরাধ প্রবণতা রোধে করণীয় নির্ধারণ এবং সামগ্রিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে ভূমিকা পালন করতে হয়।
অ্যারিস্টটল ও প্লেটো থেকে শুরু করে সম্রাট আলমগীরের পুত্রের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক আর স্কটিশ চার্চ কলেজের শিক্ষক ড. সিদ্ধেশ্বর সাঁই ও তার ছাত্র পার্থপ্রতিম পাঠকের সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের স্বর্ণালি অধ্যায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। এছাড়া জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, সরদার ফজলুল করিম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একেকজন আদর্শ শিক্ষকের উজ্জ্বল উদাহরণ। বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকের সেই চিরায়ত সম্পর্কে যেন চিড় ধরেছে। এর কারণ, এখন শিক্ষক কোনো আদর্শ ব্যক্তিত্ব নন আর ছাত্রও অনুগত শিষ্য নয়। বর্তমানে ছাত্র ও শিক্ষক অনেক ক্ষেত্রে যেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষকের ভূমিকা নিষ্ক্রিয়। বর্তমানে ছাত্ররাই সক্রিয় বলদর্পী। তারা যখন-তখন শিক্ষককে অপদস্ত ও লাঞ্ছিত করতে পারে, এমনকি প্রাণনাশের কারণও হতে পারে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্রই শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা লক্ষ করা যায়। এতে রাষ্ট্রের মর্যাদার তেমন কোনো ক্ষতি বা বৃদ্ধি হয় না বলে অনেকে মনে করে।
বর্তমান সমাজে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিতি নিয়ে কথা বলতে নেই, টিউটোরিয়াল-অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে নেই, পরীক্ষার সময় নকল ধরতে নেই, ব্যবহারিক-মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্ন করতে নেই, ক্লাসে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ে ধমক দিতে নেই, চুলের ফ্যাশন ও পোশাক নিয়ে কথা বলতে নেই এবং শিষ্টাচার শেখাতে নেই। সর্বোপরি কোনো হিতোপদেশও দিতে নেই। উল্লেখ্য, আতঙ্ক (১৯৮৬) চলচ্চিত্রে ন্যায়নিষ্ঠ অধ্যাপক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একটি বাণী এখানে মেনে চলতে হয়-‘মাস্টার মশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।’ পণ্ডিতদের ধর্মে রবীন্দ্রনাথ বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘যার সবকিছু পণ্ড হয়ে গিয়েছে, সেই পণ্ডিত।’ এ তথাকথিত দুর্বল, ভীরু, গেঁয়ো ও দন্তবিহীন শিক্ষক সমাজকে সঙ্গে নিয়েই আমরা মানসম্মত শিক্ষা অর্জন করতে চাই।
বর্তমান সমাজে শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে ক্ষমতাকেই প্রাধান্য দেন। এক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষমতা যেখানে মুখ্য হওয়ার কথা ছিল, সেখানে শিক্ষকরা শিক্ষাকে একরকম পরিত্যাগ করে প্রশাসক হওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাচর্চায় নিজেদের যুক্ত করছেন। শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি শিক্ষকদের আগ্রহ কমছে, ক্ষমতার চর্চা বাড়ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ১৯৫২ সালে ইসরাইলের প্রথম প্রেসিডেন্ট ওয়াইজম্যানের মৃত্যুর পর বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু যার মধ্যে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আনন্দ নেই, তার কাছে ক্ষমতা মূল্যহীন। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গবেষণাকেই জীবনের ব্রত হিসাবে বেছে নিয়েছেন। আমাদের শিক্ষকরাও যদি এমন ভাবতে পারতেন, তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞান অন্বেষণ করা সম্ভব হতো। আমাদের দেশে শিক্ষকসমাজ যদি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে আন্তরিকতা, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা ও সততার মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করত, তাহলে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক দেশ হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব হতো। সর্বোপরি, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব হতো। শিক্ষকদের অবহেলা করে, তাচ্ছিল্য করে, লাঞ্ছিত করে সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া আর সম্ভব হতো না।
লেখকঃ গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/০৯/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়