ড. এম এ মাননান
আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, ঘটনাটি কতিপয় পথহারা যুবকের একটি বিক্ষিপ্ত কাণ্ড। অনেক ঘটনার মতো এটিকেও এরকম কিছু মনে করলে এ দুর্ভাগা জাতি একদিন নিজের কারণেই পথ হারাবে। মাত্র আট দিন আগে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে-বাইরে অগণিত ছাত্রছাত্রীর সামনে একজন প্রবীণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে যেভাবে অমানবিক ও নির্লজ্জভাবে অপমান করা হলো এবং অপমানের শেষ পর্যায়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হলো, তা থেকে কি আমরা কিছুর ইঙ্গিত পাচ্ছি? যদি পাই ভালো কথা। আর যদি না পাই, তাহলে এ হতভাগা জাতির ‘খবর’ আছে। শুধু সাবধান নয়, হতে হবে জোর প্রতিবাদী আর সকল মনোযোগ একত্র করে হাত দিতে হবে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণে, যাতে কেউ ভবিষ্যতে মনের ভুলেও এমন নির্লজ্জ ঘটনা ঘটানো তো দূরের কথা চিন্তা করতে গেলেও বুক কেঁপে ওঠে। যে দুর্বৃত্তরা (যদিও ছাত্র নামের তকমা লাগিয়েছে গায়ে) নিজের শিক্ষকের গায়ে আগুন লাগিয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপে তাদের শক্তির পরিচয় দিতে চায়, তাদের এরূপ জংলি হওয়ার পেছনে সমাজের কোনো ধরনের ব্যক্তিরা সজ্ঞানে দুর্বৃত্ত তৈরির ভূমিকা পালন করে, তাদের পরিচয়ও জনসমক্ষে আনতে হবে। তাদেরও সাবধান করে দিতে হবে এই বলে যে, তাদেরও নিস্তার নেই পরিণামে; তারাও সমান অপরাধী, ছাড়া পাবে না তারা তাদের হাতে তৈরি এসব ফ্রাংকেনস্টাইনের হাত থেকে। প্রভাবশালী, প্রতাপশালী, হোমরাচোমরা, যা-ই ডাকা হোক না কেন তাদের, তারা জনমানুষের হাতেই নিগৃহীত হবে একদিন তাদের অপকর্মের দরুন। অর্থবিত্ত কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় কোনো কিছুই তাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না। ইতিহাস তার সাক্ষী।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আজকাল হরহামেশা শিক্ষকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করা হচ্ছে। সমাজ কিন্তু গা ছাড়া ভাব দেখাচ্ছে। শঙ্কার বিষয়টা এখানেই। স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডিতে এমন লোকজন ঢুকছে, যারা হয় বকলম না হয় একেবারেই কম শিক্ষিত। পত্রিকায় অবাক হয়ে দেখলাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে শিক্ষিত লোক না হলেও নাকি সদস্য হতে পারবে এমন একটা নীতিমালা তৈরির বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। এমনটা যদি হয়, তাহলে আর আমাদের কোনো চিন্তাই করতে হবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গোল্লায় যাবে আর আমরা ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে না পাঠিয়ে মনের আনন্দে গোয়াল ঘরের কাজে লাগিয়ে দেব।
সবকিছু দেখেশুনে ছোটকালের শেখা আপ্তবাক্যগুলো এখন আর মনে রাখতে কিংবা শুনতে একবারেই ভালো লাগে না। মুরুব্বিরা বলতেন, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আরও বলতেন, শিক্ষকরাও জাতির মেরুদণ্ড। কোন শিক্ষাটা জাতির মেরুদণ্ড, তা নিয়ে যথেষ্ট ফাঁপরে পড়ে যাই আজকাল। যে শিক্ষাটা কিছু জংলি ছাত্র-নামধারীরা দেবে সেটা, নাকি যে শিক্ষাটা সুশিক্ষিত ব্যক্তিরা (যাদের আজকাল দয়া করে ‘শিক্ষক’ বলা হয়) দেবে সেটা? জংলি ছাত্রদের জংলিপনা যেভাবে বাড়ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, তাতে মনে হয় না ‘শিক্ষক’ নামের কারো কোনো প্রয়োজন আছে। ‘ছাত্র’ কথাটা বলছি এজন্য যে, ছাত্রীরা এখনো জংলিপনাটা মনে হয় রপ্ত করতে পারেনি। আশীর্বাদ করি, তারা যেন যেভাবে আছে সেভাবেই চিরকাল থাকে। তাহলে অন্তত এটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে, জাতির ভবিষ্যেদর একটা অংশ হলেও এখনো সুশিক্ষা নিতে চায়, দেশটাকে যাতে কেউ ‘দুর্ভাগা’ না বলতে পারে সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারবে। কেন জানি মনে হয়, আমাদের মেয়েরাই আমাদের ভবিষ্যতের দিকপাল। এরাই বাঁচিয়ে রাখবে শিক্ষকদের সম্মান। এটা কেন মনে হলো? ২রা জুলাই চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসির একজন ৬৮ বছর বয়সি সুনামধারী শিক্ষককে যেভাবে কতিপয় ছাত্র নামধারী জংলি দুর্বৃত্ত টেনেহিঁচড়ে ভবনের বাইরে নিয়ে গিয়ে লাঞ্ছিত করে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল (শেষ পর্যন্ত পারেনি শুধু কয়েকজন ছাত্রীর সাহসী হস্তক্ষেপের কারণে), সেখানে দুর্বৃত্তায়নের গণ্ডির বাইরে থাকা ছাত্রীরাই শেষ পর্যন্ত একজন নিরীহ অধ্যাপকের সম্মানসহ জান বাঁচিয়ে ছিল। তাদের মতো কন্যাদের ধন্যবাদ জানাই। ছাত্রীরাই এখন দেখছি দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায়, প্রতিষ্ঠানে রুখে দাঁড়াচ্ছে। জোর আওয়াজ তুলছে। প্রতিবাদী হচ্ছে। এমনকি জীবন বাজি রেখে প্রকাশ্য রাস্তায় হামলাকারী-খুনিদের রুখে দিচ্ছে, প্রতিহত করছে। বীর পুরুষেরা তো হাতে চুড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হয়।
যেমনটা দেখেছি, বরগুনায় খোলামেলা রাস্তায় নয়ন বন্ডের মতো অল্প বয়সি দুর্বৃত্তরা একজন যুবককে তার স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলল, অথচ উপস্থিত কয়েকশ ‘পুরুষ-যুবক-ছাত্র’ টুঁ-শব্দটি করল না। সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে লম্পট অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু জীবিত থাকা অবস্থায় ধমকি-হুমকিতে পিছপা হয়নি। মাদ্রাসার ছাত্ররা কিন্তু নুসরাতের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। অনেক স্কুল-কলেজে ছাত্রীরাই প্রতিবাদী হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছে, লড়ছে। একটা বিরাট অংশের ছাত্রদের মধ্যে নিষ্পৃহতা দেখে আমরা শঙ্কিত।
চট্টগ্রামের শিক্ষকের গায়ে আগুন লাগানোর ঘটনায় বহু ছাত্র সেখানে ছিল, তারা তো দর্শকের ভূমিকা নয় শুধু, রীতিমতো হামলাকারীদের সহায়কের ভূমিকা নিয়েছে। সত্যিই আমরা হতভাগা। আমাদের দেশ ঠিক আছে, ঠিক নেই শুধু আমরা। এই আমরা কারা? আমরা তরুণ-তরুণীরা। ছেলেরা চারদিকে নির্যাতকের ভূমিকায় নেমেছে। নির্যাতিত হচ্ছে মেয়েরা। তারপরও মেয়েরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে রাস্তায় নামছে। মনে হয়, ভবিষ্যত্ মেয়েদের হাতেই। চট্টগ্রামের ইউএসটিসির সেই ছাত্রীদের বলছি, তোমরা বুঝিয়ে দিয়েছ; যেসব দুর্বৃত্ত ছাত্র তোমাদের সামনে তোমাদের প্রিয় শিক্ষককে শুধু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অপমান করেছে, মেরে ফেলতে চেয়েছে, তারা পুরো শিক্ষক জাতিকে অপমান করেছে। আর তোমরা কয়েকজন ছাত্রী শিক্ষকের সম্মান রক্ষা করেছ, দুর্বৃত্তদের আগুন থেকে বাঁচিয়েছ। এ-ও তোমরা বুঝিয়ে দিয়েছ যে তারা একজন শিক্ষককে অপমান করে সারা দেশের শিক্ষকের গায়ে অপমানের ধুলা ছিটিয়েছে এবং সে কারণে ‘অপমান হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’
আমরা চাই না, এমন দুর্বৃত্ত সন্তান কারো ঘরে জন্মগ্রহণ করুক, এমন অসভ্য-বর্বর ছাত্র কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকুক। যারা এসব কুসন্তানের জনক-জননী, তাদেরও ধিক্কার জানাই; তারা তাদের সন্তানদের জন্ম দিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন—মানুষ করার দায়িত্ব নেননি। শিক্ষককে আগুনে পুড়িয়ে মারার মতো ঘৃণ্য উল্লাসে মেতে ওঠা কলঙ্কের মশালধারী ওই ছাত্ররা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নিত দুর্বৃত্ত। স্থানীয় নেতারাও তাদের চেনেন। ওখানকার সবাই চেনেন। এমনতরো চেনাজানা কলঙ্কিত ছাত্র নামধারীদের সবারই বিচার দ্রুত করতে হবে—এই দাবি করাটা নিশ্চয়ই অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
কিছু পত্রিকার খবর দেখে মনে হয় (যদি সত্য হয়), এই বর্বর অচিন্তনীয় ঘটনা সংঘটনে প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের ইন্ধন থাকতে পারে। এরূপ প্রমাণিত হলে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি। শাস্তি না হলে কিংবা শাস্তি দেওয়ার কাজটি বিলম্বিত হলে দুর্বৃত্তরা আরো বেপরোয়া হয়ে যাবে, যা হবে সমাজের জন্য অশনি-সংকেত। আর এ কথাও ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে এরাই সরকারের সব অর্জনকে তাদের দুর্বৃত্তায়িত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একেবারেই ম্লান করে দেয়, জনমনে সরকার ও সরকারি দলের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি করে। আমাদের আশা-ভরসার স্থল যিনি, সেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যাকেও অনুরোধ করব, তিনি যেন সোনাগাজী আর বরগুনার মতোই চট্টগ্রামের এই দুর্বৃত্ত, ছাত্র নামের কলঙ্কগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে শিক্ষক সমাজের সম্মান ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন।
সামাজিক দুর্বৃত্ত এক দিনে তৈরি হয় না। তারা নিজেরা নিজেদের তৈরি করে না। তাদের তৈরি করা হয়। যারা তৈরি করে, তারাও দুর্বৃত্ত। এখন সময় এসেছে দুর্বৃত্তায়নের চক্রে গড়াগড়ি খাওয়া সব ধরনের দুর্বৃত্ত সৃষ্টিকারী আর সৃষ্ট দুর্বৃত্তদের রুখে দেওয়া এবং একই সঙ্গে যাতে ভবিষ্যতে আমাদের অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন ভূখণ্ডে কেউ দুর্বৃত্ত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সাহস না পায়, সেই লক্ষ্যে আইনগত ও টেকসই সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করা।
লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।