শিক্ষকদের সম্পূর্ণ স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ ও প্রমোশন দেওয়া উচিত

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুনঃ বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক সবাই কর্মকর্তা হওয়ার জন্য পাগল। এ এক অদ্ভূত দেশ। আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন Bangladesh Council of Scientific and Industrial Research (BCSIR)) বা যেটি সায়েন্স ল্যাব হিসাবে অধিক খ্যাত সেটি, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ইত্যাদি সবগুলো হলো মূলত গবেষণা প্রতিষ্ঠান। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যারা গবেষণা করবেন, তাদের পদের নাম ও হায়ারার্কি হওয়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো। শুধু তাই নয়, তাদের প্রমোশনও হওয়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতোই। একই কথা বলা চলে আমাদের যেসব কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স আছে, সেই কলেজের ক্ষেত্রে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পদের নাম হলো বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইত্যাদি। যেমন তাদের পদের নাম তেমনি তাদের কাজও। এসব পদে যারা চাকরি তারা গবেষণার চেয়ে bureaucratic বা আমলাতান্ত্রিক কাজই বেশি করে। এজন্যই এসব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এখন আমলাদের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এসব প্রতিষ্ঠানে যারা গবেষক হিসাবে কাজ করে তাদের সবার থাকার কথা পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টির অভিজ্ঞতা, গবেষক তৈরির অভিজ্ঞতা। তাদের প্রমোশন হওয়ার কথা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশনার ভিত্তিতে। যাদের এতো বড় বড় ডিগ্রি থাকবে, জ্ঞান সৃষ্টির অভিজ্ঞতা থাকবে তাদের উপরে কীভাবে মন্ত্রণালয়ের ছড়ি থাকে? মন্ত্রণালয় বরং তাদের কাজের ফেসিলিটেটর হিসাবে কাজ করবে, সম্মান করবে। অথচ এই গবেষকরা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তাদের প্রমোশন মন্ত্রণালয় দেয়। আমি যখন পরমাণু শক্তি কমিশনের একজন গবেষকের সঙ্গে কাজ করতাম দেখতাম সে মন্ত্রণালয়ে দৌঁড়াচ্ছে। শুধু সে না ওখানকার প্রায় সবাইকে দেখতাম মন্ত্রণালয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে। পৃথিবীর কোথায় এমন আছে?

আমাদের দেশে বিসিএসে অদ্ভূত একটা ক্যাডার আছে যার নাম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার। তারাও নিজেদের কর্মকর্তা হিসাবে পরিচয় দিতে খুব স্বচ্ছন্দ্যবোধ করে। কর্মকর্তা ও শিক্ষকের কাজের যেমন পার্থক্য, একইসঙ্গে মনস্তাত্বিক পার্থক্যও আছে। শিক্ষকতায় কোনো bureaucracy বা আমলাতন্ত্রের বালাই নেই। যেই কলেজের শিক্ষকরা অনার্স মাস্টার্স পড়ায় তারাতো আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। লন্ডনে আছে কিংস কলেজ, ইম্পেরিয়াল কলেজ কিন্তু এগুলোতে অনার্স মাস্টার্স পড়ানো হয়, পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয় ও ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে এই কলেজগুলো একদম প্রথম ২০ থেকে ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকদের প্রমোশন থেকে শুরু করে বদলি ইত্যাদি কীভাবে তাদের সহপাঠী বিসিএসের অন্য আরেকটি ক্যাডার দেয়? তাদের লজ্জা লাগে না?

প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের একটা স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের আন্দোলন করা উচিত। শিক্ষকদের তো ওয়ারেন্ট অফ প্রেসিডেন্সে থাকার প্রয়োজন নেই। আমের সঙ্গে কাঁঠালেরতো তুলনা হয় না। শিক্ষকতা ও গবেষণা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কাজ। এই কাজের উপর কোনো আম্লাতান্ত্রিকতার ছড়ি থাকতে পারে না। ছড়ি থাকলে মনস্তাত্বিক দ্বন্দ হতে বাধ্য। পৃথিবীর কোন দেশের শিক্ষকরা কর্মকর্তা হয় বা কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেয় বা কর্মকর্তা হতে চায়? স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের জন্য একটা সম্পূর্ণ স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ ও প্রমোশন দেওয়া উচিত। শিক্ষকদের কেন মন্ত্রণালয়ের পদে যেতে হবে? কেন তাদের অমুক গ্রেড তমুক গ্রেড নিয়ে দাবি জানাতে হবে? বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যদি আমলাদের সমান গ্রেড দেওয়াও হয়। তবুও কি তারা সমান হবে? আমলারা বেতনের বাইরে হাজারো রকমের সুবিধা পায়। তারা গাড়ি পান, তেল পান, বাসা পান। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা কি তা কোনোদিন পাবেন?

আমাদের শিক্ষকদের এমন একটি বেতন স্কেল দিতে হবে, যাতে কোনো শিক্ষককে পার্টটাইম পড়াতে না হয়, যাতে কোনো শিক্ষককে প্রাইভেট পড়াতে না হয়, যাতে সব শিক্ষক যথেষ্ট ফ্রি সময় পায়। ক্রিয়েটিভ ভালো মানের শিক্ষক পেতে হলে শিক্ষকদের দৌঁড়ের উপরে রাখলে চলবে না। সৃষ্টিশীল কাজে প্রচুর ফ্রি টাইম লাগে, যা অন্যরা দেখলে ভাবতে পারেনÑ স্যার কিছু করছে না। আসলে তখনই সবচেয়ে ভালো কাজটি হচ্ছে। ওই সময়ই শিক্ষক ও গবেষকরা চিন্তার যাবার কাটে। আমার অনুরোধ বাংলাদেশের যতো কলেজ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোর কোনো পদের নামে যেন কর্মকর্তা না থাকে। এসব পদের নাম হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদের মতো। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি, তাই তাদের আলাদা বেতন স্কেলে বেশি বেতন দিতে হবে। শিক্ষক ও গবেষকদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বেঁধে রাখলে এই দেশের শিক্ষা ও গবেষণা জিন্দেগিতেও উন্নত হবে না।

লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৪/১০/২০২৩      

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়