অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে সব ক্যাডারে একইসঙ্গে বিসিএস প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সব ধাপ পেরিয়ে চাকরি পান। এরপরও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা কেন নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন? বৈষম্যগুলো কী কী?
পদায়ন ও সংবর্ধনা: সব ক্যাডারের প্রথম যোগদান হয় তাঁদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে। শিক্ষা ক্যাডারের যোগদান হয় পদায়নকৃত কলেজে। সব ক্যাডারে যোগদানের পর টিএ/ডিএ পায়, যেটা শিক্ষা ক্যাডার পায় না। সব ক্যাডারের সদস্যদের যোগদানের সময় সংবর্ধনা দেওয়া হলেও শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে এটা বিরল। কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু আয়োজন করা হলেও তা নগণ্য।
বনিয়াদি প্রশিক্ষণে সমস্যা: সব ক্যাডারের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ হয় ছয় মাসের, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারকে এ ক্ষেত্রে চার মাসের ট্রেনিং দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়। অন্য সব ক্যাডারের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ হয় সাভারের জাতীয় লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিপিএটিসি) কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের প্রশিক্ষণ সাভারের বিপিএটিসিতে হয় না।
প্রমোশন অসুবিধা: চাকরির বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর হলে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সব ক্যাডার পদোন্নতি (ষষ্ঠ গ্রেড পেলেও), শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের পদোন্নতি দেওয়া হয় না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাচভিত্তিকও পদোন্নতি হয় না। ফলে নানা জটিলতায় ভরপুর এ ক্যাডার। অন্য ক্যাডারে পদোন্নতির জন্য পদ খালি থাকার প্রয়োজন হয় না, তাঁরা সুপার নিউমারি পদে পদোন্নতি পান আর শিক্ষা ক্যাডারে পদ খালি নেই বলে পদোন্নতি দেওয়া হয় না। আবার নতুন পদ সৃষ্টিও করা হয় না।
মূলত উপরের ৩টি বঞ্চনার কারণে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার সবচেয়ে অবহেলিত। বিসিএসের সকল ক্যাডারদের মধ্যে পছন্দের তালিকা করলে এটা মোটা দাগে তালিকার তলানিতে থাকবে। এই বিষয় নিয়ে আমি অনেক লিখেছি। সকল শ্রেণীর শিক্ষকদের সমস্যা নিয়ে আমি অনেক লিখেছি। কেন লিখেছি? কারণ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশের সকল সমস্যার মূলে মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যেমন কোথাও চাকরি না পেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে আসে তেমনি কেউ বিসিএস ক্যাডারের প্রশাসন, পুলিশ, ট্যাক্স ইত্যাদির কোনো একটিও না পেলে শিক্ষা ক্যাডারে যায়। অথবা শিক্ষা ক্যাডারে পেলে আবার বিসিএস দেয়। অন্য কোনো ক্যাডার না হওয়া পর্যন্ত যতোবার দেওয়া যায় ততোবার দিয়ে চেষ্টা করে। ব্যতিক্রম আছে। আমার এক মেধাবী ছাত্র ছিলো। তার জীবনের ব্রতই ছিল সে শিক্ষক হবে। তাও স্বনামধন্য কোনো বেসরকারি স্কুল প্লাস কলেজে। অন্য কোনো চাকরি সে করবে না।
বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষোভের আরেকটি কারণ হলো তাদের পদ হারানোর। কোন পদ? কারিগরি, মাদ্রাসা, প্রাইমারি অধিদপ্তর, এনটিআরসিএসহ শিক্ষা ভবনে কিছু প্রশাসনিক পদ আছে সেগুলো শিক্ষা ক্যাডার চায়। এসব পদ কেন শিক্ষকরা চায়? পৃথিবীতে সেরা চাকরি হলো শিক্ষকতা। এই চাকরি করে জ্ঞানের প্রবাহে থাকা, মানুষের জীবনের সেরা সময়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকা, নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে সর্বদা উন্নত করা যায়। অথচ আমি বেতন পাবো। কী সাংঘাতিক না? আমার মাধ্যমে দেশে শিক্ষিত রুচিসম্মত মানুষ তৈরি হবে। কী সাংঘাতিক নয়? তাহলে শিক্ষকতা রেখে আমি কেন প্রশাসনিক পদে যেতে চাইবো? একবার প্রশাসনিক পদে গিয়ে ফিরে আসলে সে আর সত্যিকারের শিক্ষক থাকবে না। তার মাইন্ডসেট পরিবর্তন হয়ে যাবে। তাই শিক্ষকদের কোনো প্রশাসনিক পদে পদায়ন হোক, সেটা আমার কখনোই পছন্দ হয়নি। কিছু প্রশাসনিক পদ থাকলে শিক্ষকদের মাঝে ওইসব প্রশাসনিক পদ পাওয়ার জন্য অনৈতিক দৌঁড়ঝাঁপ থাকবে, যা নিজেদের মধ্যে একটা অসুস্থ পরিবেশ তৈরি করবে। বরং শিক্ষকতা পেশাটাকে উন্নত করার দাবি জানানো উচিত। এটা নিজেদের এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক।
দেশের প্রতিটি ঘরে কী চাওয়া? সন্তানের সুশিক্ষা। আমলা বলুন, পুলিশ বলুন, মন্ত্রী রাজনীতিবিদ বলুন, ব্যবসায়ী বলুন, চোর, ডাকাত বলুন সবাই চায় তাদের সন্তান যেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়। সেই চাওয়া পূরণের কারিগর হলো শিক্ষক। শিক্ষকদের ভালো রাখা, শান্তিতে রাখা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। অথচ রাষ্ট্র শিক্ষকতা পেশাটিকে এমন অবহেলায় রেখেছে যে এই পেশায় সত্যিকারের ভালো ছাত্ররা আসছে না। আসলেও নানা বঞ্চনা ও অবহেলায় তাদের মেধা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কম বেতন ও কম সুবিধা পাওয়ার কারণে ধান্দাবাজ হয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে খারাপ পড়িয়ে প্রাইভেট বা কোচিং ব্যবসা রমরমা করছে। এই ধান্দাবাজ শিক্ষক দিয়ে সৎ মানুষের দেশ তৈরি করতে পারবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ঠিক একই কাজ করছে। একটি সার্ভে করুন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কতো অংশ কতো জায়গায় পার্টটাইম পড়ায়। তার উপর এখন আবার ৭ কলেজের নানা কাজেও ব্যস্ত থাকে। তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়বে কীভাবে? আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান খারাপ হলে তার আছর দেশের সর্বস্তরে পড়তে বাধ্য। আমার ক্লাসের সেরা ছাত্ররা এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছে না। প্রথম ১০ জনের প্রায় সবাই বিদেশে চলে যাচ্ছে। কদাচিৎ কেউ কেউ থেকে যাচ্ছে। কিন্তু দিন যতো যাচ্ছে ট্রেন্ড ততো বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারদের বলি আপনারা যতোদিন ওই ক্যাডারে থাকবেন, যতোদিন আপনাদের বদলি ও প্রমোশন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার ঠিক করবে ততোদিন আপনাদের কোনো বঞ্চনার অবসান হবে না। যেখানে থাকলে মান সম্মান নিয়ে টিকে থাকতে পারবেন না সেখান থেকে বের হওয়ার আন্দোলন করার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের প্রশাসন ক্যাডার এতো বড় দেশ প্রেমিক হয়ে যায়নি যে তারা ভাববে শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেই পেশা ঠিক না হলে তাদের সন্তানরা সুশিক্ষা পাবে না ও দেশ ভালো চলবে না।
এজন্যই আমি অনেক দিন ধরেই বলে আসছি শিক্ষকদের জন্য একটা আলাদা স্বাধীন শিক্ষা কমিশন করার জন্য। শিক্ষকদের জন্য একটা স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রণয়নের জন্য। এমন একটি বেতন স্কেল যাতে কোনো শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার বাহিরে অন্যত্র অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ না করতে হয়। সকল শিক্ষক যদি যথেষ্ট ভালো বেতন পায়, তারা যদি কেবল তাদের প্রতিষ্ঠানে আত্মনিয়োগ করে তাহলে অভিবাবকদেরও টাকা সাশ্রয় হয়, ছাত্রদের সময় সাশ্রয় হয়, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম কমবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেখানে শিক্ষকদের প্রচুর ফ্রি টাইম দরকার যেন তারা চিন্তা করতে পারে, যা পড়ে সেটা নিয়ে যাবর কাটতে পারে। শিক্ষকদের অভাব অনটনে রেখে রাষ্ট্রকে সুখী সুন্দর অসম্ভব।
লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৫/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়