রাজশাহী কোর্ট মহাবিদ্যালয়: অভিযোগের পাহাড় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে
অনিয়ম-দুর্নীতির দুই মামলা তদন্ত করছে দুদক
রাজশাহীঃ রাজশাহী কোর্ট মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ একেএম কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। গত সাড়ে ৭ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে তিনি কলেজের বিভিন্ন খাত থেকে দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার, সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও চরম স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলার তদন্ত করছে দুদক। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবরও অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
অধ্যক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কলেজের সাবেক হিসাবরক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন রাজশাহীর সিনিয়র স্পেশাল মেট্রো দায়রা জজ আদালতে দুটি মামলা করেছেন। মামলায় অধ্যক্ষসহ চার শিক্ষককে আসামি করা হয়েছে। মামলার তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর এ দুটি মামলায় সাক্ষী রয়েছেন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান উপাধ্যক্ষ রবিউল আলমসহ ১৭ শিক্ষক।
কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর আবেদন করেছেন। এছাড়াও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বেসরকারি কলেজ শাখায় অভিযোগ দিয়েছেন বাদশা। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক প্রলয় দাস তদন্ত শুরু করেন। তবে এ তদন্তে অধ্যক্ষ সহযোগিতা করেননি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা লিখিতভাবে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। আদালতে করা দুটি মামলার এজাহার এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর করা আবেদনে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহার ও অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্টে ২৪ জন শিক্ষক নিয়োগে নজিরবিহীন দুর্নীতি করেন অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান। নিয়োগকৃত শিক্ষকদের কাছ থেকে কলেজের উন্নয়নের জন্য অনুদান হিসাবে ৫৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আদায় করেন। কিন্তু তিনি অগ্রণী ব্যাংক, রাজশাহী মহানগরীর কোর্ট বাজার শাখায় কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা দেন ৩৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা। বাকি ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি।
বেসরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী একজন অধ্যক্ষ মাসের শেষে পাঁচ হাজারের বেশি টাকা জমা রাখতে পারবেন না। কিন্তু অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক লাখ ৩৩ হাজার ৪৫২ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫২ টাকা এবং ২০২০-২১ সালে সাড়ে ৩ লাখ টাকা নিজের কাছে রাখেন। পরবর্তীতে এ টাকা আর কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা দেননি। এভাবে তিনি ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ২০৪ টাকা হাতিয়ে নেন।
২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক সম্মান শ্রেণির প্রথমবর্ষের ফরম পূরণে শিক্ষার্থী প্রতি রসিদের মাধ্যমে চার হাজার ৫০০ টাকা আদায় করা হয়। পরে রসিদ পালটে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা দেন। এভাবে শিক্ষার্থী প্রতি দুই হাজার টাকা করে মোট ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এছাড়া একই বর্ষের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাবদ সাত লাখ ৪৩ হাজার টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয় চার লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা।
২৩ অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি; বিএ, বিএসসি ও বিকম পাশ কোর্সের শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ, কলেজের উন্নয়ন ফি, সেমিনার ফিসহ বিভিন্ন খাত থেকে মোট দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান।
জানা গেছে, কামরুজ্জামান ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। ২১ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষের চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর আবেদন করেছেন।
মামলার বাদী কলেজের সাবেক হিসাবরক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। তিনি দৃশ্যমান দুর্নীতির মাধ্যমে কলেজের দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর অদৃশ্যমান দুর্নীতি করে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন, সেটি বলতে পারব না।
সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, তিনি (কামরুজ্জামান) আবারও চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছেন। আশা করছি, এরকম দুর্নীতিবাজ একজন ব্যক্তির চাকরির মেয়াদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাড়াবে না।
সব অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান বলেন, আর্থিক লেনদেন ও বিভিন্ন খাতে আয়-ব্যয়ের বিষয়টি কলেজের হিসাবরক্ষক দেখেন। অনিয়ম বা দুর্নীতির বিষয়টি তিনিই বলতে পারবেন। আমার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক নয়। শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগও ভিত্তিহীন। আর আমার বিরুদ্ধে তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগটিও বানোয়াট।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, যিনি (অধ্যক্ষ) টাকা নিয়ে চাকরি দিয়েছেন, তিনি অন্যায় করেছেন। আর যিনি চাকরির বিনিময়ে টাকা দিয়েছেন, সেটিও অন্যায় করেছেন। যেসব অভিযোগগুলো অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে উঠেছে, সেগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত করবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/০৯/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়