কুড়িগ্রামঃ সরকারি বিধিমালা তোয়াক্কা না করে অনৈতকভাবে দলীয় এবং সরকারি সুযোগ সুবিধা পেতে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পদে যুক্ত হয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এতে নানা মহল থেকে সমালোচনা শুরুর পর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কুড়িগ্রামে রাজনৈতিক দলসহ তাদের অঙ্গ সংগঠনের সাবেক এবং বর্তমান কমিটিতে একাধিক নারী-পুরুষ শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। সরকারি চাকরি করে অনেকেই রাজনৈতিক পদ পেতে তথ্য গোপন করে বিভিন্ন পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন। আর এসব পদ-পদবি ব্যবহার করে তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনৈতিক ও সরকারি সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন অনায়সে। সরকারি চাকরি করেও দলের প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিক সুবিধা ও স্থানীয় প্রশাসনকে চাপে রাখছেন সুবিধাভোগীরা। এতে সাধারণ মানুষের কাছে দল এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে দেখা যায়,কুড়িগ্রাম ফুলবাড়ি উপজেলার ফকিরের কুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক মিলন। তিনি সহকারী শিক্ষকের পাশাপাশি ফুলবাড়ি উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন। একই উপজেলার পূর্ব কুরুষা ফেরুষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান মুকুল উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক পদ ধরে আছেন। নিজের শিক্ষকতা পেশাকে গোপন করে নারী উদ্যোক্তা পরিচয়ে নাগেশ্বরী উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের পদ নিয়েছেন রায়গঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইসমত আরা সেফু। মুনিয়ার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাদিজা সুলতানা কেয়া জেলা মহিলালীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদিকা পদে ছিলেন। তার বিদ্যালয়ের এক নারী সহকর্মী গর্ভবতী না হয়েও মোটা অংকের বিনিময়ে সেই নারী শিক্ষককে মাতৃত্বকালীন ছুটি দেন। বিদ্যালয়ের সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎসহ বিদ্যালয়ে নিয়মিত না এসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তিনি কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ের নেতাদের পরিচয় দিয়ে নেতাকর্মী এবং সহকর্মী ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
চিলমারী উপজেলা মসজিদের পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুস সাত্তার উপজেলা আওয়ামী লীগেরসহ সভাপতি পদে এবং রাণীগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কুঠির গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আয়নাল হকসহ জেলায় আরও অনেক শিক্ষক প্রধান রাজনৈতিক দলসহ অঙ্গ সংগঠনের পদ পদবিতে থাকার তথ্য উঠে আসে।
জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনি তরফদার বলেন, খাদিজা সুলতানা কেয়া জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, তিনি নিয়মিত স্কুলে আসেন না। কেন্দ্রীয় নেতাদের পরিচয় বহন করে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ববৃন্দসহ সরকারি কর্মকর্তা ও তার স্কুলের সহককর্মীদের কোণঠাসা করে রাখেন। সেই প্রভাব বিস্তার করে কেয়া কিছুদিন আগে আমাকেও লাঞ্ছিত করেছেন।
প্রভাষক আব্দুল কাদের বলেন, শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নন, জেলার বিভিন্ন সরকারি বিভাগের কর্মরত চাকরিজীবীরা জেলা ও উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায় রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। তারা ব্যক্তি স্বার্থে দল ও সরকারি সুযোগ সুবিধা আদায় করে থাকেন। ফলে স্কুলগুলোতে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। আর অন্য বিভাগে নাগরিকরা সঠিক সেবা থেকেও বঞ্চিত হওয়ায় সরকারের উন্নয়ন সাধারণ মানুষের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
নাগেশ্বরী উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও সহকারী শিক্ষক ইসমত আরা সেফু প্রতিবেদকের সঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আমি রাজনীতি করি কিনা আপনাকে জানাতে বাধ্য নই।
রায়গঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু হানিফা বলেন, ইসমত আরা সেফু রায়গঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকলেও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি তার জানা নেই।
ফুলবাড়ি উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সহকারী শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক মিলন শিক্ষক ও দলীয় পদে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, পদে থাকলেও নির্বাচনসহ সরকারি কাজে কোনো ধরনের প্রভাব তিনি বিস্তার করেন না।
দলের বিপদের সময় তিনি এই উপজেলা যুবলীগের হাল ধরেছেন। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান মুকুল বলেন, চাকরি সরকারি হওয়ার আগে তিনি দলীয় এই পদে রয়েছেন। এখনও পদ থেকে পদত্যাগ করেননি বলেও জানান। তবে আগামীতে কী করবেন তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি বিএনপির এই নেতা।
রাণীগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক আয়নাল হক বলেন, আমি সরকারি চাকরি করে দলকে প্রাধান্য দেই না। যখন দলীয় পদে আসছিলাম তখন চাকরি সরকারি হয়নি। এরপর আর কাউন্সিল না হওয়ায় এখন সেই পদে রয়েছি। আগামীতে থাকবো না দলীয় পদে।
চিলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সহকারী শিক্ষক আব্দুস সাত্তার পদে থাকার কথা নিশ্চিত করলেও সরকারি চাকরি করে দলীয় পদে থাকার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কুড়িগ্রাম শাখার সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অ্যাড. আহসান হাবীব নীলু বলেন, জেলায় সরকারি চাকরিজীবীরা সরকারি দল ও বিরোধী দলের বিভিন্ন পদ-পদবিতে রয়েছেন। একই সঙ্গে সরকারি চাকরি করে রাজনৈতিক দলের পদে থাকা পুরোপুরি বেআইনি। তারা রাজনীতি করার কারণে প্রশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ করেন। তারা ব্যক্তিগতভাবে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন। এতে করে স্কুলের পাঠদান ও নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। এই প্রচলন বন্ধ হওয়ার দরকার বলেও তিনি দাবি করেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন দাবি করে তিনি বলেন, যদি কারো বিরুদ্ধে দলীয় পদে থাকার সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্র; ঢাকা টাইমস
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৩/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়