ম্যানেজিং কমিটি পদ্বতির বিকল্প ব্যবস্থার প্রত্যাশা

মুহাম্মাদ হযরত আলী ।।

শিক্ষা মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ীকমিটির সভায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনান্তে,বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি গঠনে নতুনভাবে নিতিমালা প্রনয়নের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়।

শিক্ষা পরিবারের একজন ক্ষুদ্র সদস্য হিসেবে সম্মানিত বিশেষ কমিটির মাননীয় সদস্য গনের সদয় বিবেচনার প্রত্যাশায় আমার কিছু খোলা মতামত নিম্নে উপস্থাপন করছি।

সর্বশেষ ২০০৯ সালে প্রণীত নীতিমালার আলোকে বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ গঠন এবং এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অবশ্য ২০০৯ সালের বিধিমালার কোন কোন ধারা উপধারা ইতিমধ্যে কয়েক মরতবা আংশিকভাবে সংশোধনও করা হয়েছে।নীতিমালা সংশোধনের জন্য গঠিত উপকমিটি হয়তো বা সর্বশেষ এ নীতিমালা সামনে রেখেই পরবর্তী নীতিমালার সার সংক্ষেপে বা প্রতিবেদন তৈরি করবেন কিন্তু বাস্তবতার আলোকে ও দেশের বর্তমান সামাজিক,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ নিয়ে বিবেচনা বিশ্লেষণ পুর্বক প্রতিবেদন তৈরি করা জরুরি বলে আমরা মনে করি।

আমাদের জানামতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বা ব্যাবস্থাপনা কমিটির রেওয়াজ স্মরণাতীত কাল থেকেই বিদ্যমান ছিল,তবে একসময় এসব কমিটির সরকারি অনুমোদনের ব্যবস্থা ছিলনা।

এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্ব প্রথম ১৯৬২খ্রিঃ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রেজিষ্ট্রেশন নিতিমালা প্রনয়ণ করা হয়।এ নীতিমালায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ থাকলেও এর কোন রুপ-রেখা,গঠন পদ্ধতি বা সরকারি অনুমোদনের বিধি-বিধান চালু করা হয়নি,ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন কারী কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতকরেই পরিচালনা কমিটি গঠন এবং পদ- পদবি সহ সদস্য তালিকা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের নিকট জমাদান অথবা নিজস্ব রেজুলেশন খাতায় সংরক্ষন করতেন।বর্নিত কমিটির তত্ত্বাবধানেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক/কর্মচারী নিয়োগ সহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হতো। প্রতিষ্ঠানের দাতা,প্রতিষ্ঠাতা, স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও সমাজ সেবক ব্যক্তিরাই এ কমিটির সদস্য বা হর্তাকর্তা হিসেবে দ্বায়ীত্ব পালন করতেন। শিক্ষকদের বেতন ভাতা প্রদান সহ যাবতীয় আর্থিক সংকুলানের দায়ীত্ব তারাই বহন করতেন ফলে শুধু মাত্র পাঠদান অনুমতি বা স্বীকৃতি প্রদান ছাড়া বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের আর কোন দ্বায় ভার ছিলনা।

প্রথম বারের মত ১৯৭৭ সালে বেসরকারি স্কুল ও কলেজ এবং ১৯৭৯ সালে বেসরকারি মাদরাসার জন্য পৃথক পৃথক ম্যানেজিং কমিটি এন্ড গভার্নিং বডি রেগুলেশন বা বিধিমালা জারী করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সরকারি অনুমোদন প্রথা চালু করা হয়।

পুর্বেই বলা হয়েছে যেহেতু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্যোগে স্থাপন এবং পরিচালনা করা হতো তাই সে বিবেচনা সামনে রেখেই তখন ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিংবডির রুপ রেখা,দায়িত্ব কর্তব্য ও কার্য্য ক্ষমতার বর্ননা সম্মিলিত বিধিমালা প্রনীত হয়।

১৯৭৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠন সংক্রান্ত ঐ বিধি মালা বা নীতিমালাই কার্যকর ছিল।
১৯৭৭ এবং ২০০৯ সালের বিধিমালায় ম্যানেজিংকমিটি বা গভর্নিং বডির গঠন পদ্ধতি, কার্যভার ও দায়িত্ব কর্তব্যের বেলায় মৌলিক তেমন কোন পার্থক্য নেই। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পরিবর্তনের অন্যতম হলো (১) কমিটির মেয়াদ ৩ বছরের স্থলে ২ বছর, (২) শিক্ষক ও অবিভাবক সদস্য পদে একটি করে সংরক্ষিত মহিলা আসনের পদ শৃষ্টি ও( ৩)কমিটির সভাপতি পদে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া, আর এ বিধানটি ছিল ম্যানেজিংকমিটিকে রাজনৈতিকী করনের নগ্ন হস্তক্ষেপ (যা পরবর্তীতে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল করা হয়েছে)।

১৯৬২ বা ১৯৭৭ সালের প্রেক্ষাপট ২০০৯ সালে যেমন ছিলোনা তেমনি ২০১৯ সালেও কল্পনাতীত।শিক্ষা সংস্কৃতি, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই দেশের বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হয়েছে,আর শিক্ষা ব্যাবস্থায় ঘটেছে আমুল পরিবর্তন।
যেখানে স্থানীয় জনগণের আর্থিক সাহায্যের উপর নির্ভর করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতো,সেখানে আজ শিক্ষকদের শতভাগ বেতন ভাতা বহন করছে সরকার।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, শিক্ষার্থীর সংখাও বেড়েছে বহুগুন, প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ,কারীগড়ি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা,তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যাবস্থা প্রবর্তন এবং পর্যাপ্ত মনিটরিং পদ্বতির মাধ্যমে দক্ষ জন শক্তি গড়ে তোলার পুরো দায়ীত্বই বহন করছে সরকার,এনটিআরসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রমও চলছে সরকারী নিয়ন্ত্রণে। শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে পাঠ্য বই,লেখা পড়ার খরচ যোগানে উপবৃত্তি,মেধা বৃত্তি সহ সরকারি সুযোগ সুবিধার অন্ত নেই। এসব বিষয়ে সরকারি পদক্ষেপ এর বিস্তারিত বিবরন উল্লেখ করতে গেলে আমার আলোচনার মুল বিষয় অন্তরালে চলে যেতে পারে বিধায় এসব নিয়ে আজ আর নয়, মহান আল্লাহ তায়ালা তৌফিক প্রদান করলে অন্য সময় পৃথক আলোচনার আশা পোষণ করছি।

আমার আলোচ্য বিষয় হলো “বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিংকমিটি পদ্বতির বিকল্প ব্যবস্থা প্রয়োজন”।সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম, কো-কারিকুলাম, সিলেবাস, কর্মপরিধি ও একাডেমিক ব্যবস্থা,শিক্ষারমান, শ্রেনী শাখা, স্তর ও শিক্ষার মান সবই এক এবং অভিন্ন ,ফলে শিক্ষা ব্যাবস্থায় সরকারি বেসরকারি নামের বৈষম্য অবসানের বিষয়টি এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে স্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগ,আগ্রহ ও সহযোগিতার বিষয়টি অস্বীকার করছিনা তবে প্রতিষ্ঠানটি যখন সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তখন তাদের খুব বেশি কর্তৃত্ব বজায় রাখার সুযোগ বা প্রয়োজনীয়তা আর বিদ্যমান থাকেনা বরংসরকারি নিয়ম,কানুন ও বিধি বিধানের ভিত্তিতেই চলতে হয় বা চালাতে হয় এসব প্রতিষ্ঠান।

অতএব নৈতিক দিক থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে আর বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলার সুযোগ থাকেনা বরং পরিচয়ের এই দুর্বল বিষয়টি গুনগত মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে প্রতিবন্দ্ধকতার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়।

দেশেরসকলধরনের(এমপিওভুক্ত)বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভুমিকা পালন করছে । সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুনে, মানে এবং সংখায় কোন দিকেই কমনয়।পরিচালনা কমিটি এখন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই দুর্ভোগের কারন। ১৯৭৭সাল থেকে বর্তমান অবধি সাধারণত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় খুব ভাল অবদানের কথা অনেক সময়ই শুনা যায়না। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রের কথা আলাদা। ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সামাজিক ক্ষমতার দ্বন্ধ, রাজনৈতিক স্বার্থপরতা ও অর্থনৈতিক লুলোপ দৃষ্টি ভঙ্গির দরুন অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক গতিতে কাংক্ষিত নিয়মে চলার ক্ষেত্রে অদৃশ্য বাধার সম্মুখীনও হচ্ছে। এমতাবস্থায় ম্যানেজিংকমিটি বা গভর্নিংবডির অক্টোপাসে আবদ্ধ রেখে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গতি পথে বাধা শৃষ্টি করা দেশ ও জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি পরিচালনা কমিটির প্রয়োজন না থাকে তাহলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ম্যানেজিংকমিটি বা গভর্নিংবডির কি প্রয়োজন আছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। অতএব আমরা মনে করি প্রচলিত পরিচালনা কমিটির পদ্বতির আশু বিকল্প ব্যবস্থা প্রনয়ণ করা দরকার।

সে লক্ষ্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সুষ্ঠু তদারকি ও মনিটরিং ব্যবস্থা সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার যথার্থ নীতিমালা তৈরি এখন সময়ের দাবী। জেলাপ্রশাসকদের সম্মেলনে উৎথাপিত জেলা উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষাকমিটি গঠনের প্রস্তাবটিও যুগোপযোগী হয়েছে বলে আমরা মনে করি

তবে এক্ষেত্রে জেলা উপজেলা শিক্ষা কমিটি গঠন প্রকৃয়া কিভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত করা যাবে তার সুনির্দিষ্ট মতামত ও সুপারিশ সংসদীয় স্থায়ীকমিটির নিকট জাতি আশা করতে পারে। কেননা রাজনৈতিক বিবেচনা বা প্রভাবে গঠিত কোন কমিটির মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুনগত মান সম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব নয়। আলোচিত বিষয় গুলো বিবেচনায় নিয়ে সংসদীয় স্থায়ীকমিটির মাননীয় সদস্য বর্গ এবিষয়ে এমন সুপারিশ মালা প্রনয়ণ করবেন যা দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুকে অদুর ভবিষতেই জাতীয় করনের মাইল ফলক হিসেবে কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে জাতিকে একটি উন্নতমানের শিক্ষা ব্যবস্থা উপহার প্রদানের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।

লেখক-শিক্ষক ও কলামিস্ট