গাইবান্ধাঃ ম্যানেজিং কমিটি গঠন, প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগ, একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রধান ও জমিজমা সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৩৫টি বেসরকারি কলেজ, মাধ্যমিক, নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা, কারিগরি স্কুল এবং কলেজের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২০ বছর থেকে পর্যায়ক্রমে একাধিক মামলা নিম্ন আদালত হতে হাইকোর্ট পর্যন্ত চলমান রয়েছে।
এসব মামলার কারণে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস এবং জড়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম মারাত্বকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১৫৯টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে কলেজ ১৫টি, মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল ৮৬টি, মাদ্রাসা ৪৯টি এবং কারিগরি স্কুল ও কলেজ ৯টি। এসবের মধ্যে ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বর্তমানে চলমান রয়েছে।
২০১১ সালে উপজেলার ধর্মপুর ডি ডি এম উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালিন ম্যানেজিং কমিটি প্রধান শিক্ষক হিসেবে শরিফুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়। এরপর ২০১৭ সালে একই পদে নিয়োগ দেয় শিরিন মোছা. সামসোদ বেগমকে। দুইজন প্রধান শিক্ষক তাদের বৈধতা নিয়ে আদালতে মামলা করেন।
প্রতিষ্ঠান প্রধান শরিফুল ইসলাম বলেন, ম্যানেজিং কমিটি তাকে বিধি মোতাবেক নিয়োগ দেয়। অপরদিকে প্রতিষ্ঠান প্রধান দাবিদার শিরিন মোছা.সামসোদ বেগমের ভাষ্য বিধি বহির্ভুত এবং স্বাক্ষর জাল করে তিনি নিয়োগ নিয়েছেন।
সে কারণে ম্যানেজিং কমিটি তাকে ফের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এনিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি মামলা। শরিফুল ইসলাম জানান, ২০১৭ সাল থেকে হাইকোর্টে হাফ ডজন মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে সর্বস্ব বিক্রি করে বর্তমানে সর্বস্বান্ত।
শুধুমাত্র বাপ-দাদার বসতভিটার মধ্যে পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তিনি ন্যায় বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন। ২০২১ সালে উপজেলার নতুন দুলাল ভরট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হক অবসর গ্রহণ করেন। বিধি মোতাবেক কমিটি ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দেয় সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহিনুর বেগমকে।
বিদ্যালয়ের জুনিয়র সহকারী শিক্ষক জাহেদুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাহিনুর বেগমের সহকারী প্রধান শিক্ষকের নিযোগ অবৈধ দাবি করে আদালতে মামলা করেন এবং নিজেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দাবি করে আসছেন।
এদিকে উপজেলা প্রশাসন মানবিক কারণে বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আশরাফ আলীর মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনভাতা প্রদান করছেন। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে তিনজন শিক্ষক প্রতিষ্ঠান প্রধানের দাবি করছেন। এসব জটিলতার কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে পাঠদান কার্যক্রম মারাত্বকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
চলতি বছরের ২৮ জুন উপজলার ঝিনিয়া এম এ উচ্চ বিদ্যালয়ে বিধি মোতাবেক ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। কমিটির সভাপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধান শিক্ষকের সাথে নির্বাচিত সদস্যদের মতবিরোধের কারণে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে এনিয়ে আদালতে একাধিক মামলার সূত্রপাত হয়েছে। প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেক বলেন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিধি বহির্ভূতভাবে কমিটির সভাপতি নির্বাচন করেছেন। নির্বাচিত সদস্য এবিএম আনিছুর রহমান রাজুর ভাষ্য নির্বাচনে প্রধান শিক্ষকের পক্ষের প্রার্থী নির্বাচিত না হওয়ায় তিনি সভাপতি নির্বাচনের সভায় অনুপস্থিত ছিলেন এবং রেজুলেশনে স্বাক্ষর করেননি। সে কারণে আদালতে মামলা হয়েছে।
এছাড়া উপজেলার ভুরাঘাট সিনিয়র মাদ্রাসা, চন্ডিপুর গেন্দা মরিয়ম সিনিয়র মাদ্রাসা, আব্দুল মজিদ মন্ডল উচ্চ বিদ্যালয়, ফলগাছা উচ্চ বিদ্যালয়, ধর্মপুর আব্দুল জব্বার ডিগ্রী কলেজ, বজড়া হাতিয়া উচ্চ বিদ্যারয়, আলহাজ সেলিনা কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ, হামিদা খাতুন কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ, এসআইডি ভোকেশনাল স্কুল এন্ড কলেজ, উত্তর রাজিবপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ঘগোয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ ৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে।
ঝিনিয়া এম এ উচ্চ বিদ্যালয়ের অভিভাবক শহিদুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাস হতে মামলা সংক্রান্ত কারণে প্রধান শিক্ষক স্কুলে আসেন না। সহকারী প্রধান শিক্ষক স্কুল পরিচালনা করে আসছেন। ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি কমে গেছে, পাঠদান কার্যক্রম মারাত্বক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের দায়িত্বহীনতাকে এসবের মূল কারণ বলে দাবি করেন এই অভিভাবক।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল মমিন মন্ডল বলেন, ছয় মাস হলো তিনি এই উপজেলায় যোগদান করেছেন। এই উপজেলায় এত সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে মামলা এটি তার জানা ছিল না। প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদ-পদবি এবং নিয়োগ সংক্রান্ত কারণে প্রধান শিক্ষক ও কমিটির সভাপতির মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ নিয়ে ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তরিকুল ইসলাম জানান, এক মাস আগে তিনি সুন্দরগঞ্জে যোগদান করেন। প্রতিদিন রুটিন কাজের বাইরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মামলার নথিপত্র তাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। হাইকোর্টের আদেশের বাইরে কোন কাজ করার সুযোগ নেই। এনিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঠিক নজরদারির অভাব বলে মনে করেন তিনি।
দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক প্রফেসর মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ৮টি জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
সামান্য ঘটনা ঘটলেই পক্ষ-বিপক্ষ হাইকোর্টে মামলা করছে। আইনের বাইরে কোন কিছু করার সুযোগ নেই। সে কারণে আদালতের আদেশকে সম্মান জানিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। মামলায় জড়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠদান কার্যক্রম মারাত্বকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে সমাধানের দাবি জানান তিনি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জানান, সুশিক্ষা ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার বড় অন্তরায় হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মামলা। সারাদেশে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মামলার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে সমাধানের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৮/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়