‘মানুষ যাহা চেষ্টা করে, তাহাই সে পায়’

 সম্পাদকীয়
প্রায় শত বৎসর পূর্বে কাজী নজরুল ইসলাম লিখিয়াছেন, ‘আসিতেছে শুভদিন,/ দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!’ সেই শুভদিন আসা সহজ নহে, তবে তাহা একসময় আসিবে নিশ্চয়ই। গত অর্ধশতকে চারিদিকে বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার বৈভব বাড়িয়াছে; কিন্তু তাহার ভিতরেও উন্নয়নশীল বিশ্বের সাধারণ মানুষের মনে হতাশার চোরাস্রোত বহিয়া যাইতেছে। সমগ্র বিশ্বই এত অস্থিতিশীল ও অস্থির হইয়া উঠিতেছে যে, পৃথিবীবাসী যেন স্বস্তিময় জীবন হইতে ক্রমশ সরিয়া যাইতেছে বহু যোজন দূরে। যদিও কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, ‘সুখ’ ব্যাপারটা হইল ‘স্টেট অব মাইন্ড’। এই ক্ষেত্রে কোটি টাকার প্রশ্ন তোলা যায়—কতখানি সুখে রহিয়াছে বাংলাদেশের মানুষ? মহাভারতের একটি অংশ হইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিয়াছিলেন ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতা। সেইখানে এক জায়গায় যখন আত্মীয়দের হটাইয়া অখণ্ড রাজ্য অর্জন করিয়াছিলেন তখন তাহার পিতা ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন—‘এখন কি হইয়াছ সুখী?’ দুর্যোধন তখন দম্ভ ভরিয়া এই উত্তর দেন—‘সুখ চাহি নাই মহারাজ!/ জয়, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।’ অর্থাত্ সুখের দরকার নাই, জয় অর্জনই তাহার লক্ষ্য। সুতরাং বিশ্বের অনেকের নিকট দুর্যোধনের মতো জয়টাই মুখ্য, সুখ নহে। আর এইখানেই যত সংকট, যত নেতিবাচক অভিজ্ঞতা।

ইহা সত্য যে, এই পৃথিবীতে মঙ্গলের পাশাপাশি অমঙ্গল থাকিবেই। এই জন্য চৈনিক দার্শনিক কনফুশিয়াস বলিয়াছেন ধৈর্যের কথা। তিনি মনে করিতেন, ধৈর্যের অভাবের কারণে অনেক বড় বড় সম্ভাবনা ধ্বংস হইয়া যায়। বিখ্যাত ফারসি কবি জালালউদ্দিন রুমি মনে করিতেন—ধৈর্য মানে ভবিষ্যেক দেখতে পাওয়া। এই জন্য সর্বশক্তিমান স্রষ্টা যখন মানুষকে সীমাহীন কষ্ট, বালামুসিবত, বাধাবিপত্তির মধ্যে ফেলেন, তখন তিনি দেখিতে চাহেন—ঐ ব্যক্তি ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে সক্ষম কি না। যাহার মধ্যে ধৈর্য নাই, ধরিয়া লইতে হইবে তিনি একজন দুর্বল মনের মানুষ। একইভাবে, যাহার ধৈর্য নাই, তাহার মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং সাহসও নাই। অধৈর্য অস্থিরতা কত বড় ক্ষতি করিতে পারে, তাহার উদাহরণ দেওয়া যায় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক গুলজারের দেশভাগসংক্রান্ত একটি গল্প হইতে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় একটি গরিব পাঞ্জাবি পরিবার সদ্যোজাত যমজ বাচ্চা লইয়া ভিড়ে ঠাসা ট্রেনের ছাদে উঠিয়াছেন। ভিড়ের চাপে বাবা-মা খেয়ালই করেন নাই কখন তাহাদের একটি বাচ্চা মারা গিয়াছে। ট্রেন তখন নদী পার হইতেছে, একজন বলিয়া উঠিলেন, সর্দারজি, মরা বাচ্চাকে আর কোলে রাখিয়া লাভ নাই, গুনাহ হইবে, নদীতে ভাসাইয়া দাও। দেশভাগ, দেশত্যাগ, বাচ্চার মৃত্যু—সর্দারজির তখন মাথার ঠিক নাই, তিনি বউয়ের কোল হইতে জোর করিয়া বাচ্চাটিকে টানিয়া লইয়া ছুড়িয়া দিলেন নদীর জলে। রাতের অন্ধকারে একটি বাচ্চার কান্নার কণ্ঠ শোনা গেল। পরক্ষণেই সর্দারজি সন্দিহান হইয়া বউয়ের কোলে হাত দিয়া দেখিলেন—তাহার বউ মরা বাচ্চাটিকে কোলে লইয়া কাঠ হইয়া বসিয়া আছেন। জীবিত বাচ্চাটি তখন নদীর গভীরে। অর্থাত্ তাড়াহুড়া করিতে গিয়া তিনি মৃত বাচ্চার পরিবর্তে জীবিত বাচ্চাটিকেই ট্রেনের জানালা দিয়া বাহিরে ছুড়িয়া ফেলিয়াছেন!

আমরা অনেক ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করিতে গিয়া হীরা ফেলিয়া কাচ তুলিয়া লই হাতে। অমূল্য হীরা হারাই, আর যেই কাচ তুলিয়া লই, তাহাতে হাত কাটে। সুতরাং যাহা করিবার তাহা করিতে হইবে ঠান্ডা মাথায়। ইহার সহিত ভুলিয়া গেলে চলিবে না—একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন আধাসামন্তবাদী সমাজ হইতে আমাদের উত্তরণ ঘটিয়াছে। কোনো অন্ধকারই রাতারাতি দূর হয় না। ইহাও দূর হইতে সময় লইবে। মহান সৃষ্টিকর্তা পবিত্র কুরআনের সুরা নাজম ৩৯ নম্বর আয়াতে বলিয়াছেন—‘মানুষ যাহা চেষ্টা করে, তাহাই সে পায়।’ সুতরাং আমাদের সঠিক কাজটি করিতে হইবে।