শিক্ষায় সবার সমান অধিকার। এই অধিকারও সবার। একটি জাতির শিক্ষা হলো তার এগিয়ে যাওয়ার মূল নির্দেশিকা। জীবন আলোকিত করার দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য পূরণে শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান অবলম্বন। মেধা ও মননে আধুনিক ও চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই পারে একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আর তারই ধারাবাহিকতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রণীত ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সরকারের একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আর প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে শিক্ষার প্রথম সোপান। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষার দর্শন ও বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা একই সুতোয় গাঁথা। তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবনা শুরু করেছিলেন, যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষাই শিক্ষার মূল ভিত্তি। তাই এই শিক্ষা নিয়ে ভাবনা শুরু করেন।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ একটি প্রেসনোটের মাধ্যমে জানানো হয় যে, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাবে। বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন এবং তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। বর্তমানে ১ম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপাদমস্তক একজন শিক্ষানুরাগী। তিনি জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা ছিল তার রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তিমূল। Pause Unmute Close PlayerUnibots.in বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও দর্শনকে ধারণ করে যে কোনো জাতি একটি আধুনিক কর্মমুখী এবং বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশ উত্তরোত্তর যে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যার মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা যাবে এবং সোনার বাংলা বিনির্মাণ সহজতর হবে। দক্ষ মানবসম্পদ বা সোনার বাংলা গড়তে আমাদের শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। আর এই শিক্ষার ভিতই হলো প্রাথমিক শিক্ষা। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন অনুসরণ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক।
জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ১৭টি অভীষ্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (SDG) প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও ৩৩২টি পরিমাপক রয়েছে। যার মধ্যে ৪ নম্বর অভীষ্ট হলো মানসম্মত শিক্ষা (অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমাজতান্ত্রিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা।) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, রূপকল্প-২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়নে দক্ষ জনসম্পদ উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। গুণগত শিক্ষার অনেক অপরিহার্য পূর্বশর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এ কথাও অনস্বীকার্য, বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে খরচ করা হয় না, যা অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত। দেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.৯২ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষা উপখাতে বরাদ্দ মাত্র ০.১২ শতাংশ, যা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম।
উল্লেখ্য, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট জিডিপির তুলনায় যথাক্রমে ৪.৫ ও ৩.৫ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান জাতীয় বরাদ্দ ০.৯২ থেকে ক্রমান্বয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে ২ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ শতাংশে উন্নীত করা আবশ্যক। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের বর্তমান বরাদ্দ ৮ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধানতম উপায় হলেও দেশে শিক্ষায় অর্থায়ন এখনো হতাশাব্যঞ্জক। ইউনেস্কো গঠিত ‘একবিংশ শতাব্দীর জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন’ তথা ইউনেস্কো গঠিত দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে (১৯৯৭) এ সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে মানবসম্পদের সার্বিক উন্নয়ন। জাতীয় উন্নয়ন অর্জন করতে হলে উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রধান উপাদান। বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়, তা অপ্রতুল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার, শ্রীলংকায় ১০ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, মালয়েশিয়ায় ১৫০ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার। গুণগত শিক্ষা কোনো একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে অর্জনের আশা করা যায় না।
এর জন্য প্রয়োজন অনেক উপাদানের সমন্বিত এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাণ্ড। গুণগত শিক্ষার জন্য যেসব উপাদানের যথাযথ সমন্বয় সাধন করতে হয় সেগুলো হচ্ছে- আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান সামগ্রী ও ভৌত অবকাঠামো, যথার্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি, ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ ইত্যাদি। শিক্ষার সব স্তরে গুণগত মান অর্জনের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সুপারিশগুলোর আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ করা যেতে পারে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে দক্ষতার মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেই। এর বিপরীতে অপচয়ের হার কমিয়ে দক্ষতার মান বাড়াতে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ দক্ষতা ও অপচয়কে রোধ করতে হবে, যাতে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষৎ প্রজš§কে সত্যিকারের মানবসম্পদে রূপান্তর করা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে অভিভাবক ও শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যকার সঠিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত করা আবশ্যক। মূল্যায়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার সাধন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সব দিক অর্থাৎ স্বাস্থ্য, আচার-আচরণ, প্রকাশভঙ্গি, মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা ইত্যাদি বিবেচিত হয় এবং তথ্য সংগ্রহকরণ কৌশল ও বিশেষায়িত ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্ভব হয়। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের বিষয় নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে অভিভাবক, বিদ্যালয় বা শিক্ষকদের ইচ্ছা ও পছন্দ মোতাবেক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত।
কোন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কী হতে চায়, কিংবা কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চায়, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীর পছন্দ বা মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া আবশ্যক। এতে তার পঠিতব্য বিষয় সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগবে; ফলে সে পাঠে মনোযোগী হবে, শিক্ষাগ্রহণ করে পরিতৃপ্ত হবে এবং আশানুরূপ ফলাফল করবে। প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার নতুন ভবন নির্মাণ করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ পরিবেশে পাঠ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমাবেশ আয়োজন করে শিক্ষার সঙ্গে সমাজকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- বছরের শুরুতে প্রতিটি স্কুলে ক্যাচমেন্ট এলাকাভিত্তিক শিশু জরিপপূর্বক ভর্তি নিশ্চিত করা। নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, হোম ভিজিট কার্যক্রম, এসএসসি ও পিটিএ সভা, বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ, উপবৃত্তি প্রদানসহ মাসিক কার্যক্রমে মাঠ প্রশাসন আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীল আচরণের ফলে প্রাথমিক শিক্ষার উৎকর্ষ সাধিত হবে।
টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে রূপকল্প ২০২১, ২০৪১ ও ডেল্টাপ্ল্যান বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষার আধুনিকায়ন অত্যাবশ্যক। আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত উৎপাদনমুখী অভিযোজনে সক্ষম, সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলাই আমাদের প্রত্যাশা।
পলাশ সরদার : প্রাবন্ধিক ও উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, গোপালগঞ্জ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০২/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়