শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ মাধ্যমিকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে আগামী জানুয়ারিতে। নতুন এ শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক অথবা বিজ্ঞান বিভাগ বেছে নেয়ার আর কোনো সুযোগ থাকছে না। সেক্ষেত্রে সব শিক্ষার্থীকেই বাধ্যতামূলকভাবে সাধারণ ১০টি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।
এতদিন মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের বিভাগভিত্তিক বিষয়ে অন্তত ৪০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে। রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি উচ্চতর গণিত, জীববিজ্ঞান, কৃষি শিক্ষা ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একটিকে বাধ্যতামূলক ও একটিকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
তবে বর্তমান শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলোকে একীভূত করে ১০০ নম্বরের ‘বিজ্ঞান’ হিসেবে পড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষায়িতের পরিবর্তে ‘একমুখী’ হিসেবে অভিহিত নতুন এ শিক্ষাক্রম প্রচলনের বিষয়টিতে আপত্তি তুলছেন শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবকদের বড় একটি অংশ। তাদের ভাষ্যমতে, নতুন এ শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞানের মতো বিশেষায়িত শিক্ষা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। ‘একমুখী’ এ শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য হিসেবে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমুখী করে তোলার কথা বলা হলেও এর বিপরীত ঘটে যাওয়ার বড় আশঙ্কা রয়েছে। সমন্বিতভাবে সব পড়ানো হলে শিক্ষার্থীরা সবকিছু সঠিকভাবে শেখার সময় পাবে না। বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষায় আরো অনাগ্রহী হয়ে পড়তে পারে তারা।
স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম থেকে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিকের মতো বিভাগভিত্তিক বিশেষায়ন তুলে দেয়া হচ্ছে। ১৯৯০ সালেও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ১১ বিষয়ে মোট ১ হাজার নম্বরের পরীক্ষা হতো। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য মোট নম্বর ছিল ৩০০, যা ছিল মোট নম্বরের ৩০ শতাংশ। ২০০০ সালে এসএসসিতে মোট বিষয় ছিল ১১টি। নম্বর ছিল ১ হাজার ১০০। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নম্বর ছিল ৪০০। ওই সময়ে মোট নম্বরের ৩৬ শতাংশ ছিল বিজ্ঞানে। ২০১৭ সালে মোট বিষয় ছিল ১৪টি। এর জন্য মোট নম্বর ছিল ১ হাজার ৩০০। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোয় বরাদ্দ ছিল ৪০০ বা মোট নম্বরের ৩১ শতাংশ। সর্বশেষ নতুন শিক্ষাক্রমে নবম-দশম শ্রেণীতে মোট বিষয়ে রাখা হয়েছে ১০টি। ১ হাজার নম্বরের পরীক্ষায় বিজ্ঞানে থাকছে ১০০, যা মাধ্যমিক পরীক্ষায় মোট নম্বরের মাত্র ১০ শতাংশ।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মোট ১০টি বিষয় থাকবে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। এছাড়া এতদিন মাধ্যমিকে পরীক্ষা হয়েছে নবম ও দশম শ্রেণীর পাঠ্যক্রম মিলিয়ে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে শুধু দশম শ্রেণীর পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে।
নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে উচ্চতর পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো কমবে বলে আশঙ্কা শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের বড় একটি অংশের। তারা বলছেন, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এতদিন ধরে নবম-দশম শ্রেণীতে পৃথকভাবে তুলনামূলক বড় পরিসরে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতের মতো বিষয়গুলোয় পড়াশোনা করে আসছে। মাধ্যমিকের পর যত ওপরের স্তরে যাচ্ছে, বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হারও তত কমছে। এ অবস্থায় মাধ্যমিক পর্যায়েই বিজ্ঞান শিক্ষার পরিসর সংকুচিত করে আনলে পরে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো কমে আসবে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থীর হার ছিল যথাক্রমে ৩১ শতাংশ, ৩১ দশমিক ৯৪, ৩০ দশমিক ৯২, ২৮ দশমিক ১৯ ও ৩১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উঠে এ হার আরো অনেকখানি কমে গেছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল যথাক্রমে ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ, ২৩ দশমিক ৩৫, ২৩ দশমিক ৪২, ২২ দশমিক ৫০ ও ২৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে স্নাতক পর্যায়ের চূড়ান্ত পরীক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোর অংশ নেয়া পরীক্ষার্থীর হার ছিল ১৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে এ হার ছিল ১৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০২০ সালে এর হার দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশে। তবে ২০২০ সালের এ তথ্যকে অসম্পূর্ণ বলে স্বীকার করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, কভিডের কারণে ওই বছরের সম্পূর্ণ তথ্য সংকলন করা সম্ভব হয়নি। সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া গেলে এ হার আরো অনেকখানি কমে আসার কথা। এছাড়া ২০২১ ও ২০২২ সালেরও সম্পূর্ণ তথ্য এখন পর্যন্ত প্রকাশ হয়নি।
নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বক্তব্য হলো ‘এ শিক্ষাক্রমে নবম ও দশম শ্রেণীতে ‘বিজ্ঞান’ বিষয়ের অধীনে অনুপাত ও পরিমাণ, সিস্টেম, সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ সজীব এবং অজীব বস্তুগুলোর গঠন ও আচরণ, পদার্থের গঠন ও আচরণ, বস্তু ও শক্তির মিথস্ক্রিয়া, স্থিতি ও পরিবর্তন, জীববিজ্ঞান এবং পৃথিবী ও মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে এমনভাবে পড়ানো হবে যাতে তারা বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা অর্জন করে, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় এবং তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।’
যদিও নতুন শিক্ষাক্রমের এ উদ্দেশ্য আদতে পূরণ হবে কিনা, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে শিক্ষকদের মধ্যেও। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বরিশালের একটি কলেজের রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, ‘আগে যেসব শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের বিষয়ে আগ্রহী ছিল, তারাই বিজ্ঞান বিভাগে যেত এবং তাদের বিশেষভাবে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোয় জোর দিয়ে পড়তে হতো। এ কারণে তারা এসব বিষয়ে বেশি সময় দিতে পারত এবং সবকিছু ভালোভাবে শেখার সুযোগ পেত। কিন্তু এখন তাদের যখন সবকিছু নিয়ে পড়তে হবে, তখন তারা শুধু বিজ্ঞানে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারবে না। আর এটি অস্বীকারের সুযোগ নেই যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে পড়তে তুলনামূলক বেশি সময় দিতে হয়। তাই সামনের দিনগুলোয় যখন এখানে সময় কমে যাবে বা অন্য বিষয়ের বাড়তি চাপ নিতে হবে তখন এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন ও ধারণও আগের তুলনায় অনেক কমে যাবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হলো সবাই গণিত-পদার্থবিদ্যা পড়তে আগ্রহ অনুভব করে না। এমন কাউকে আমরা যখন জোর করে এসব বিষয় চাপিয়ে দিচ্ছি, তখন তারাও কতটা শিখতে পারবে তা নিয়েও সংশয় থেকেই যায়। সব মিলিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমে বিভাগ বিভাজন তুলে দেয়া বড় জটিলতা তৈরি করতে পারে।’
এদিকে বিশ্বের প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি দেশেই মাধ্যমিক পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয় নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে এবং সমন্বিত বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে পৃথকভাবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত পড়ানো হয়। চীনের শিক্ষা ব্যবস্থায় ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সে জুনিয়র মাধ্যমিক স্কুল সম্পন্ন করতে হয়। দেশটিতে এ স্তরেই শিক্ষার্থীদের গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের মতো বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো তুলনামূলক বিস্তারিতভাবে শেখানো হয়। একইভাবে ইংল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিষয়ে অধ্যয়ন করতে পারে এবং নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিজ্ঞান, কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয় বেছে নিতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘আমাদের দেশে শিক্ষার অনেক ভাগ—মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা। এসব বিভাজন সমাজে বৈষম্য তৈরি করছে। দেখা যায় সবচেয়ে গরিব শিশুটি যাচ্ছে কওমিতে আর সবচেয়ে ধনী শিশুটি ইংরেজি মিডিয়ামে। আমরা এ বৈষম্য তুলে দেয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সরকার এর পরিবর্তে বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্যের বিভাজন তুলে দিয়েছে, যা আমাদের শিক্ষাকে আরো হুমকির মুখে ফেলেছে। এ শিক্ষার ফলে আমরা আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা মেধাবী বিজ্ঞানের গবেষক পাব না। সবাই সব শিখতে গিয়ে দেখা যাবে কেউই কিছুই ঠিকভাবে শিখছে না। আর মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার এ অপূর্ণতার কারণে সে উচ্চপর্যায়ে আর বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহীই হবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইংল্যান্ডে অনেক নামি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী আছেন। তাদের শিক্ষা পদ্ধতি পরীক্ষিতভাবেই সফল। আর তাদের সে শিক্ষাক্রম তো আমাদের দেশেও প্রচলিত আছে। আমরা যদি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে চাই, তাহলে সেই শিক্ষাক্রমটি গ্রহণ না করে কেন শিক্ষার্থীদের নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে যাচ্ছি?’
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিখন ঘাটতির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানও। তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে কিছুটা শিখন ঘাটতি হবে ঠিকই, কিন্তু তা আমরা উচ্চ মাধ্যমিকে পুষিয়ে নিতে পারব। আমরা এটা করছি যাতে শিক্ষার্থীরা মানবিকতা, মূল্যবোধ, দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি সবকিছু মাধ্যমিক অবধি ভালোভাবে শেখে। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকে তারা নিজেদের পছন্দের বিষয়ে পড়বে। এখন উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞানে ৩৫ শতাংশ সময় দিচ্ছে তারা। তখন ৭৫ শতাংশ সময় বিজ্ঞানে দেবে। আর এতদিন মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন করে আমরা কয়জন বিজ্ঞানী তৈরি করতে পেরেছি? নতুন এ শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কমবে না। বরং আগে বিজ্ঞান নিয়ে কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে যে ধারণাহীনতা ছিল, তা কাটিয়ে ওঠা যাবে।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৩/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়