গোলাম মোস্তফাঃ আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে দেশে মাধ্যমিক স্তরে একমুখী শিক্ষা চালু হতে যাচ্ছে। নবম শ্রেণিতে উঠে শিক্ষার্থীদের আগের মত বিজ্ঞান বিভাগ, মানবিক বিভাগ ও বাণিজ্য বিভাগ বাছাই করে পড়তে হবে না। শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকেই একই পাঠ্যক্রমে একই বিষয়গুলো পড়তে হবে।
অতঃপর মাধ্যমিক স্তর পার হয়ে শিক্ষার্থীরা যখন একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হবে তখন তারা নিজ নিজ পছন্দমত বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ বাছাই করে পড়তে পারবে। একেই বলা হচ্ছে “একমুখী শিক্ষা”। হিসাব মতে ২০২৪ সালে শুরু হওয়া একমুখী শিক্ষার প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালে। এর ফলে চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন হবে।
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি পাঠদান, পরীক্ষায় নম্বর বন্টনসহ পরীক্ষার ফলাফলে নতুন নিয়ম চালু হবে। এতে বর্তমান গ্রেডিং পদ্ধতি বিলুপ্ত হবে। তবে নতুন এই একমুখী শিক্ষায় বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করে নতুন কি পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি, ফলে অন্ধকারেই রয়েছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
১৯৬২ সালে বর্তমান নবম শ্রেণি থেকে বিভাগ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, ২০২৩ সালে তার সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আধুনিক যুগে বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের যোগ্য, দক্ষ ও কর্মঠ হিসাবে গড়ে তুলতে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই।
একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও আদর্শবান শিক্ষক হিসাবে গড়ে তোলা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মাণ করার প্রয়োজন পড়বে। সেই সাথে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় নোট বই ও গাইড বই মুক্ত শিক্ষা কতটুকু সফল হবে তা ভেবে দেখার বিষয়।
আর মাত্র দুই মাস পর শুরু হবে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ। এত অল্প সময়ের মধ্যে এতবড় কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করা কষ্ট সাধ্য। এছাড়া আগামী জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলের সময় দেশের একমুখী শিক্ষা চালু করা হচ্ছে। ব্যাপক আলোচনা না করে মাধ্যমিক শিক্ষায় এতবড় পরিবর্তন দেশে কতটুকু ফলপ্রসু করা যাবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
২০০৫ সালে তৎকালীন সরকার একমুখী শিক্ষা চালু করতে চেয়েছিল। সেসময় শিক্ষাবিদদের প্রবল বাধার মুখে তা আলোর মুখ দেখেনি। তারপর থেকে নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে বাংলাদেশ ও বিশ^ পরিচয় নামে মানবিক বিভাগের একটি বিষয় এবং মানবিক বিভাগে সাধারণ বিজ্ঞান নামে বিজ্ঞান বিভাগের একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় যা এখনও বহাল রয়েছে।
প্রতিটি বিষয়ে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের হাতে থাকা মার্কস নিয়ে স্বজন প্রীতির আশংকা রয়েছে। শিক্ষকরা আদর্শবান শিক্ষক না হলে তা বাস্তবায়নে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতায় শিক্ষকদের যথেষ্ট বদনাম রয়েছে। যারা প্রাইভেট পড়েন সেইসব শিক্ষার্থীদের ওই শিক্ষক সকল ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকেন।
আর যারা প্রাইভেট পড়েন না তাদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমন প্রবণতা রোধ করতে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো নিষিদ্ধ করা না গেলে একমুখী শিক্ষার সুফল আসবে না। এজন্য বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা যেন শুধুমাত্র শিক্ষকতা করেই পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে পারে তার জন্য তাদের সম্মানজনক বেতন-ভাতা প্রদান করতে হবে।
শিক্ষকদের চাকুরি বদলীযোগ্য করতে হবে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী গণিত বিষয়কে ভয় পান। সে কারণে বিজ্ঞান বিভাগে তারা পড়েন না। নবম ও দশম শ্রেণিতে একমুখী শিক্ষায় উচ্চতর গণিত না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপ কমবে। দীর্ঘদিনের একটি প্রচলিত নিয়ম বাতিল করে নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের।
প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতিতে এ প্লাসকে ভালো শিক্ষার্থী হিসাবে চিহ্নিত করা হতো। শুধু পুঁথিগত বিদ্যার জ্ঞানকেই শিক্ষার্থী মূল্যায়নের মাধ্যম ছিল। কিন্তু একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি তার সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর দক্ষতা আচরণসহ নানা দিক বিশ্লেষণ করে একজন শিক্ষার্থীকে ভালো শিক্ষার্থী হিসাবে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা থাকা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধুমাত্র বই পুস্তক পড়ে এ-প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভাল ছাত্র/ছাত্রী আখ্যা দিয়ে তাদের নিয়ে মাতামাতি করে সারাদেশ। কলেজে ভর্তি কিংবা চাকুরির ক্ষেত্রে এরাই সকল সুবিধা ভোগ করে থাকে। আর অবশিষ্ট বিশাল সংখ্যার শিক্ষার্থীরা ভাল শিক্ষার্থী নয় আখ্যা দেয় বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা।
শিক্ষার পাশাপাশি একজন ভালো কম্পিউটারম্যান কিংবা অন্য কোন ক্ষেত্রে দক্ষ কোন শিক্ষার্থীকে কখনই ভালো শিক্ষার্থী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয় না। দেশের উন্নয়নে দক্ষ গোষ্ঠী তৈরিতে অবদান রাখবে এই একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-সাংবাদিক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৯/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়