বিমল সরকার:
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে কলেজগুলোর অবস্থা, আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় সম্প্রতি সরকারি হিসেবে ঘোষিত কলেজগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক।
বছরের পর বছর ধরে দু-চার-ছ’টি বিষয়ে শিক্ষক না থাকা একটি বড় ব্যাধি হয়ে দেখা দিয়েছে। নেই উপযুক্ত দেখভালের ব্যবস্থা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে নিয়মিত অধ্যক্ষ না থাকার বিষয়টি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর।
এর চেয়ে দুর্গতি-বিড়ম্বনা আর কী হতে পারে! একটু আগেই আমার একজন সুহৃদের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম। তিনি জানান, সরকারীকরণের প্রক্রিয়াধীন ২৯৯টির মধ্যে ১৩৪টি কলেজেই নাকি বর্তমানে নিয়মিত কোনো অধ্যক্ষ নেই।
তার মানে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক প্রতিষ্ঠানই অভিভাবকশূন্য। অবিশ্বাসের কোনো কারণ নেই। চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে আসল পরিস্থিতিটা।
আমার জানামতে কিশোরগঞ্জ জেলায় সরকারি হওয়া ১০টি কলেজের মধ্যে চারটি এবং পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহ জেলায় এমন ন’টির মধ্যে তিনটি অর্থাৎ এ অঞ্চলের সদ্য সরকারি হওয়া ১৯টি কলেজের মধ্যে সাতটিতেই দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত কোনো অধ্যক্ষ নেই। ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’রা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিযুক্তি- এও আরেক তেলেসমাতি কারবার। কী মধু যে এতে আছে! কেবল নিয়মকে অনিয়ম, আবার অনিয়মকে নিয়ম বানানোর প্রবণতা! দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, কখনও কখনও কোথাও কোথাও এ কাজে দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তারাও নির্লজ্জভাবে অংশ নিচ্ছেন।
কর্তাব্যক্তিরা একেক প্রতিষ্ঠানে একেকবার একেক নিয়মকানুন কার্যকর করছেন, প্রয়োজনে মনগড়াভাবে আইন বানাচ্ছেনও! ক্রম ভঙ্গ করে এক নম্বরকে পাঁচ আর পাঁচ নম্বরকে বানাচ্ছেন এক নম্বর। এ নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ, এমনকি দেনদরবার লেগেই আছে।
মামলা-মোকদ্দমা হচ্ছে, আইনকানুন লঙ্ঘন করে চেয়ার দখলকারীরা মামলায় হেরে বাধ্য হয়ে অবলীলায় চেয়ার ছেড়েও যাচ্ছেন। তড়িঘড়ি করে অনার্স বোর্ডে ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ হিসেবে নাম লেখাচ্ছেন, আবার মামলা-মোকদ্দমায় হেরে কিংবা নির্বাহী আদেশে সেই নাম মুছেও ফেলা হচ্ছে।
সম্পূর্ণ জিদের বশবর্তী হয়ে একই জায়গা থেকে সরকারি আদেশের মাধ্যমে একবার বানানো হচ্ছে ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’, পরক্ষণে তাকেই আবার বানানো হচ্ছে ‘অফিসার ইনচার্জ’। অর্থাৎ নিজেদের জিদ বহাল রাখতে হবে। শরমবোধের আকালটা এমন স্তরে এসে পৌঁছেছে যে, অনেক কিছু দেখে ও শুনে কখনও কখনও মনে হয় তাহলে আর অবশিষ্ট কী রইল!
ক্লাস-লেখাপড়ার প্রতি এমন ‘অমনোযোগ’ এবং সংকীর্ণ স্বার্থের প্রতি এত ‘গভীর মনোযোগ’ আমাদের দেশে অতীতে আর কখনও হয়েছে কি না মনে পড়ে না। সার্বিক বিচারে এ সবকিছুকে শিক্ষা-প্রশাসন কিংবা শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা বলা চলে না। আর কিছু যেমন-তেমন, শিক্ষার দিক দিয়ে গোটা জাতিরই হতাশাগ্রস্ত হতে আর বোধ করি বেশি সময় বাকি নেই।
চার নম্বরের বীজ রোপণ করে তা থেকে কখনও এক নম্বরের ফল আশা করা যায় না। অথচ বাস্তবে হচ্ছে কিন্তু তা-ই। প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, এমনই যদি হয় অবস্থা, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে কীভাবে? চলছে, এবং বেশ ভালোভাবেই চলছে। এ প্রসঙ্গে এখানে একজন ভালো মানুষকে স্মরণ করে নিবন্ধটি শেষ করতে চাই। চার দশক আগে আমাদের সম্পর্কে তার ভাবনাটা কেমন ছিল-
বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতে এক আলোকিত ও আলোচিত নাম লুৎফর রহমান সরকার (যিনি এল আর সরকার নামে সমধিক পরিচিত)। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের এমডি এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে বেশ সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
প্র্রয়াত এ সফল ব্যাংকার ব্যক্তিজীবনে খুবই সজ্জন ও একজন সুসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। মূলত রম্য রচনার জন্য তিনি খ্যাতিলাভ করেছেন। ‘জীবন যখন যেমন’ তার লেখা একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম। এ বইয়েরই একটি নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন তিনি ‘মাথা নেই তার মাথাব্যথা’।
‘জীবন যখন যেমন’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে, আজ থেকে ৪০ বছর আগে; আমাদের স্বাধীনতা লাভ করার মাত্র সাত কিংবা আট বছরের মাথায়। নিবন্ধটি হয়তো অনেকেই পড়েছেন; তবু বারবার মনে হওয়ায় এখানে এর কিছু অংশ উল্লেখ করতে চাই।
‘বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ফলে মানুষের মাথাগুলো অকেজো হয়ে জং ধরে যাচ্ছে। তাই নিয়মিত সার্ভিসিংয়ের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ চাহিদার ওপর নির্ভর করেই বিদেশে বেশ কয়েকটি ব্রেন ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব ওয়ার্কশপে নিয়মিত ব্রেইন ওয়াশ ও সার্ভিসিং করা হয়।
‘এক ভদ্রলোক জেনেভায় গিয়ে ভাবলেন তার ব্রেনটা ওয়াশ করালে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। দ্য জেনেভা ব্রেন ওয়ার্কশপ কোম্পানি তার ব্রেন খুলে নিয়ে যথারীতি রসিদ দিয়ে দিল। সাত দিন পর ডেলিভারি নিতে হবে।
ওয়ার্কশপের কর্মকর্তা লোকটিকে ব্রেনবিহীন বেশি ঘোরাঘুরি করতে নিষেধ করে দিলেন। ভদ্রলোকের বাড়ি বাংলাদেশে। নিষেধ মানার অভ্যাস নেই। তার বদ্ধমূল ধারণা, ব্রেন থাকা আর না থাকা একই কথা। কারণ আজকাল ও পদার্থের তেমন একটা প্রয়োজন কোথাও হয় না। হলে কি আর পৃথিবীর এমন করুণ দশা হয়!
‘… এদিকে সাত দিন গেল, পনের দিন গেল, এক মাসও গেল। আজও ব্রেন ফেরত নিতে এলো না দেখে দ্য জেনেভা ব্রেন ওয়ার্কশপ কোম্পানির মালিক এবার সত্যিই বিচলিত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। কোথাও কোনো অ্যাক্সিডেন্ট করে বসল না তো!
ভদ্রলোক হোটেলের যে ঠিকানা দিয়েছিলেন, সেখানে খোঁজ নিয়েও যখন তার কোনো সন্ধান মিলল না, তখন তিনি তার স্থায়ী ঠিকানা ঢাকায় টেলিগ্রাম পাঠালেন। বলা বাহুল্য, জেনেভায় বেশি ঘোরাঘুরি করার ফলে ভদ্রলোকের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে টান পড়ে যায়।
তাই ব্রেন ডেলিভারি না নিয়েই তিনি দেশে ফিরে আসেন। টেলিগ্রাম পেয়ে ভদ্রলোক যে জবাব দিলেন তা এই- চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি বাংলাদেশের এক বড় অফিসের বড় কর্তা। দিব্যি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
ব্রেন না থাকায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ এখানে ব্রেনের কোনো প্রয়োজনই হয় না। সামনের বছর জেনেভায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। গেলে অবশ্যই ব্রেন নিয়ে আসতে চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।’