শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ অনিয়মের যেন শেষ নেই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার তদারক এ প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে এসে শিক্ষক-কর্মচারীদের পোহাতে হয় অন্তহীন দুর্ভোগ। উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্তি, শিক্ষক-কর্মচারী বদলি, এমপিও- সব খানেই শুধু টাকার খেলা। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার ফাইলও তদবির ছাড়া পাস হয় না। আটকে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। হয় টাকা, নয় তো তদবির- এ দুই নীতি ছাড়া কর্মকর্তাদের কাছে আটকে থাকে অনেক কাজই। কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে জাল সনদেও হয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের পে-অর্ডার (এমপিও)। তদন্তে জাল সনদধারী শিক্ষকরা ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু মাউশি অধিদফতরের যে কর্মকর্তারা এই এমপিও অনুমোদন দেন তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জানা গেছে, এমপিও কার্যক্রমে দুর্নীতি বন্ধ করতে বিকেন্দ্রীকরণ করলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তি আর দুর্নীতি আরও বেড়েছে। এখন ঘুষ-দুর্নীতি হয় ঘাটে ঘাটে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ঘুষ ছাড়া এমপিও ফাইল সাবমিট করেন না। দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আর মাউশির উপপরিচালক কার্যালয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও। কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করলেও বড় অঙ্কের ঘুষ পেলেই ফাইল ছেড়ে দেন এই কর্মকর্তারা। ফলে জাল সনদধারী হাজার হাজার শিক্ষক পেয়ে যান এমপিও।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) সারা দেশের ৬৭৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীর জাল সনদ শনাক্ত করে। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করা হয়েছে। জাল সনদধারী এই শিক্ষকদের মধ্যে ৪৭৯ জন এমপিওভুক্ত ছিলেন। সরকারের কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা নিতেন। জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলেও যে মাউশি অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তারা এমপিও সুবিধা পেয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। অথচ সব সনদ যাচাই-বাছাই করে মাউশি অধিদফতর কর্মকর্তারাই দেন এমপিও সুবিধা।
অভিযোগ রয়েছে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অফিস না করলেও এই দফতরের অধীন কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতরের গবেষণা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে কর্মস্থলে উপস্থিত না হওয়া, অধিদফতরে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ ছাড়াও বিস্তর অভিযোগ। তথ্যমতে, গত ৮ জানুয়ারি থেকে অনুমোদন ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত তিনি। এরপর আট মাস পার হলেও কয়েক দফা কারণ দর্শানো ছাড়া তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে। এই কর্মকর্তার কারণে অধিদফতরের ইমেজ সংকটে পড়লেও তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মাউশি কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া মাউশির বেশ কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই পাওয়া যায় বাণিজ্যে জড়ানোর অভিযোগ।
শিক্ষক বদলি একটি নিয়মিত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও এই প্রক্রিয়া সম্পাদনে সারা দেশের শিক্ষক-কর্মচারীদের পোহাতে হয় অন্তহীন দুর্ভোগ-ভোগান্তি। চট্টগ্রাম মহানগরীর একটি কলেজের প্রভাষকের স্বামী রংপুরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। দেশের দুই প্রান্তে দীর্ঘদিন স্বামী-স্ত্রী চাকরি করার কারণে সংসারে চলছিল টানাপোড়েন। সেই প্রভাষক মানবিক ও যৌক্তিক কারণে স্বামীর কর্মস্থল রংপুর জেলায় বদলির জন্য মাউশিতে লিখিত আবেদন করলে এই ফাইল আটকে থাকে প্রায় দেড় বছর। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সম্প্রতি বদলি সম্পন্ন হয় এই শিক্ষকের।
মেলান্দহ গার্লস স্কুল থেকে স্বামীর কর্মস্থলে শূন্য পদে জামালপুর গার্লস স্কুলে বদলি হতে আগ্রহী এক শিক্ষিকা। বেশ কয়েক মাস আগে বদলির জন্য আবেদন দিলেও সে আবেদনের কোনো অগ্রগতি হয়নি। সম্প্রতি খোঁজ নিতে তিনি যান মাউশি কার্যালয়ে। মহাপরিচালক দফতরের সামনে এই শিক্ষিকার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। বদলি না হওয়ায় তিনি জানান তার দুর্ভোগের কথা।
শিক্ষক সংকটে পর্যুদস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা প্রায়ই ভিড় জমান মাউশি অধিদফতর কার্যালয়ে। দফায় দফায় শিক্ষকের জন্য আবেদন করেও ১০টি শূন্যপদে শিক্ষক পাননি ধোবাউড়া আদর্শ সরকারি কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তোফাজ্জল হোসেন। এই অধ্যক্ষ অবসরে যাওয়ার পর সম্প্রতি আসেন মাউশি কার্যালয়ে। তিনি বলেন, এইচএসসি ও ডিগ্রি পর্যায় মিলে প্রায় ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী এ কলেজে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে কলেজে পৌরনীতি, জীব, রসায়ন, পদার্থসহ বিভিন্ন বিভাগে কোনো শিক্ষক নেই। এ বিষয়গুলো কলেজে আর পড়ানোও হয় না। অন্য কলেজ থেকে বদলি করে শিক্ষক সংকট কাটানোর অনুরোধ জানালেও মাউশি কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বাশিস) সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম রনি বলেন, মাউশিতে শিক্ষক ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের সেবা দেওয়া দায়িত্ব হলেও এই দফতরের পরিচালকরা শিক্ষকদের পাত্তাই দেন না। এমপিওভুক্তিতে দুর্নীতি বন্ধে বিকেন্দ্রীকরণ করা হলেও এখন প্রতিটি দফতরে দফতরে ঘুষ দিতে হয়, আর উপজেলা শিক্ষা অফিসাররা ঘুষ না পেলে কোনো ফাইলই পাঠান না। এমপিওভুক্তির পুরো প্রক্রিয়া চলে একটি সিন্ডিকেটের মধ্য দিয়ে। জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু যারা যাচাই-বাছাই করে এমপিও দিলেন তারা দায় এড়াতে পারেন না, এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষায় দুর্নীতি, অনিয়ম, হয়রানি বন্ধে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে সমস্যা ও ভোগান্তি আছে এটা সত্য। তবে এগুলো লাঘব করার চেষ্টা করছি। অধিদফতরে যেন শিক্ষকদের ভোগান্তি না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক আছি; কিন্তু লোকবল সংকটের কারণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা অনুমতি দিচ্ছি। প্রকল্পের আশানুরূপ অগ্রগতি না থাকার ব্যাপারে মহাপরিচালক বলেন, জমি বুঝিয়ে দেওয়ার পরও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর বেশ কয়েক ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণ বিলম্ব করেছে, তাই কয়েক প্রকল্পে অগ্রগতি কম। সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৯/০৯/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়