ভাষা আন্দোলনে নারী যোদ্ধা অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ
ঢাকাঃ ভাষা আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের একজন ড. সুফিয়া আহমেদ। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য আইনের বিরুদ্ধে মিছিলকারী নারীদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। সেখানে ভাষা আন্দোলনের সমাবেশে তিনি বক্তৃতাও দিয়ে ছাত্রদের উজ্জীবিত করেন আন্দোলনে অংশ নিতে।
মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে সুফিয়া আহমেদ বলেন, ‘স্বাধিকার আদায় করতে হবে এটা ছিল প্রাণের তাগিদ। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই সেদিন রাস্তায় নেমেছিলাম। ১৯৫২ সালের সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসংখ্যা ছিল বড়জোর ৭০। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। এই ধারা ভাঙা হবে কি না এ নিয়ে ছাত্রনেতাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো। তবে নিয়ম-শৃঙ্খলার কঠোরতা ভেঙে মুখের ভাষা রক্ষার তাগিদে সেদিনের আন্দোলনে ছাত্রীরাও এসেছিলেন।'
তিনি আরো বলেন, বায়ান্নের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিতর্ক উঠলে ছাত্রীরা পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সেদিন সকাল থেকেই বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে মেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমতলার সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন। পুলিশি হামলার আশঙ্কায় ছাত্রীদের মিছিল না-করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো সেদিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা মাতৃভাষার দাবিতে একইসঙ্গে কণ্ঠ মেলান। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালেই আমতলা ভরে যায় ছাত্রছাত্রীদের আগমনে।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে সুফিয়া আহমদ বলেন, ‘২১ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে আমতলায় এক বিশাল ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। আমি সভায় অংশগ্রহণ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ ও বিভিন্ন স্কুলের বহু ছাত্রী সভায় উপস্থিত ছিল। ১৪৪ ধারা অমান্য করা হবে কি-না এ নিয়ে সভায় তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। সভা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না তাদের পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এক পর্যায়ে আমরা ছাত্রীরা সভা ত্যাগ করে কলাভবনে আমাদের কমন রুমে গিয়ে বসি। বহু তর্কবিতর্কের পর সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ৫ জনের খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে। আমাদেরকে কমন রুম থেকে খবর দিয়ে আনা হলো। আমরা মিছিলে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। প্রথমে ছাত্রদের ২-৩ টি দল রাস্তায় নামে। এরপর ছাত্রীদের প্রথম দলটি রাস্তায় বের হয়। এ দলে আমি, শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন নাহার এবং ইডেন কলেজের একজন ছাত্রী (নাম জানা নেই) এই পাঁচজন অংশ নেই।
ছাত্রদের মিছিল অনুসরণ করে আমরা ছাত্রীরা পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ (বর্তমান জগন্নাথ হল মিলনায়তন) এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। রাস্তায় অসংখ্য পুলিশ। মধ্যে মধ্যে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। কিছুটা আগাবার পরেই সিটি এসপি মাসুদ মাহমুদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখানে আসাটা তোমার ভুল হয়েছে। সরকার আমাদেরকে বিক্ষোভকারীদের কঠোর হস্তে দমন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তুমি বাসায় চলে যাও। তা-না হলে তোমারও বিপদ হতে পারে।’
তিনি বলেন, সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, ‘এমন সময় পুলিশ মিছিলের ওপর প্রচণ্ডভাবে লাঠিচার্জ ও ব্যাপকভাবে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। টিয়ারগ্যাসের কালো ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। টিয়ারগ্যাসের ঝাঁঝে আমার চোখে ভীষণভাবে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। চোখ লাল হয়ে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝরতে থাকে। অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করি। কোনো রকমে হাঁটতে হাঁটতে এস এম হলের প্রভোস্টের বাড়ির সামনের মাঠে আশ্রয় নেই।’ (তথ্যসূত্র: ইতিহাস সম্মিলনী ৯ প্রবন্ধ সংগ্রহ, পৃ. ২৪০)
ভাষা আন্দোলনের সময় ৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে না থাকলেও ক্যাম্পাসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত।
সুফিয়া আহমেদের জন্ম ১৯৩২ সালের ২০ নভেম্বর ফরিদপুর জেলার সদরপুরের বিষ্ণপুর গ্রামে। তার পিতা বিচারপতি মুহম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অষ্টম ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী। তার মায়ের নাম বেগম লুৎফুন্নেসা ইব্রাহিম। লুৎফুন্নেসা ইব্রাহিম ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন আদর্শ ও বিদূষী নারী।
সুফিয়া আহমেদ প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস জ্যাভিয়ার্স স্কুল এবং দার্জিলিংয়ের ডাউহিল স্কুলে। দেশ বিভাগের পর প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম ১০ জনের মধ্যে মেধা তালিকায় অষ্টম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে স্নাতক এবং ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ১৯৬০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পিএইচডি লাভ করেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত গার্লস গাইড আন্দোলনের নির্বাচিত আন্তর্জাতিক কমিশনার ছিলেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম নারী যিনি দুবার জাতিসংঘে কোনো দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রথমবার ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের হয়ে এবং পরেরবার ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের হয়ে। ১৯৯৫ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনয়ন প্রাপ্ত হন। ২০০২ সালে ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য একুশে পদক প্রদান করা হয় তাকে।
বিচারক ও আইনজীবী ভাষাসৈনিক সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের সঙ্গে ১৯৫৫ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সুফিয়া আহমেদ। এই ভাষা সংগ্রামী দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে পুত্র সৈয়দ রিফাত আহমেদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং কন্যা রাইনা আহমেদ একজন চিকিৎসক।
সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ছিলেন। ২০০৩ সালের ১২ জুলাই মারা যান। আর বার্ধক্যজনিত কারণে ৮৮ বছর বয়সে ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ মারা যান।
একজন অনন্য শিক্ষা ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেশের বাইরেও সুফিয়া আহমেদ বহুল পরিচিত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি দেশের বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করেছেন। শিক্ষা ও গবেষণা-সংক্রান্ত বিষয় ছাড়াও তিনি সংস্কৃতি, নারী উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২১/০২/২০২৪