বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: ভিসি নেই ৪০টিতে, প্রোভিসি নেই ৮৩টিতে

কোষাধ্যক্ষ নেই ৪৬টিতে

শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য (ভিসি) পদ দীর্ঘদিন ধরেই শূন্য। গত বছর তারা তিনজনের একটি ভিসি প্যানেল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু গত বছরের ২৯ নভেম্বর সে ফাইলটি মন্ত্রণালয় থেকে ফিরে আসে। তারপর গত ৯ মাসেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো ভিসি নিয়োগ হয়নি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রো-ভিসির পদটিও শূন্য রয়েছে।

সে সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছিল, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের মধ্যে অধ্যাপক ড. নিলুফার বেগম নিলুর প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকায় তার পরিবর্তে বিকল্প প্রস্তাবসহ নতুন করে তিনজনের প্যানেল প্রস্তাব পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।

একইভাবে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি চিটাগংয়ের উপাচার্য নিয়োগের ফাইলটি ফেরত আসে। মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছিল, প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের মধ্যে অধ্যাপক ড. মো. জাহিদ হোসেন শরীফের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকায় তার পরিবর্তে বিকল্প প্রস্তাবসহ নতুন করে তিনজনের প্যানেল প্রস্তাব পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। এখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির পদটি শূন্য রয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) প্রো-ভিসি নিয়োগের ফাইল ফেরত আসে এ বছরের ৯ এপ্রিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রো-ভিসি পদে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের মধ্যে ড. এএফএম নাজমুস সাদাত সহযোগী অধ্যাপক হওয়ায় তার পরিবর্তে নতুন প্যানেল পাঠাতে বলেছে।

গত বছরের ১০ নভেম্বর প্রাইম ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার নিয়োগের ফাইল ফেরত আসে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ট্রেজারারের পাশাপাশি প্রো-ভিসি পদও শূন্য রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রাইম ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের মধ্যে মু. হুমায়ূন কবীর লস্কর এবং ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার বিএন (অব.)-এর অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা না থাকায় তাদের পরিবর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুসারে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নতুন করে তিনজনের প্যানেল প্রস্তাব পাঠানোর অনুরোধ করা হলো।

প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকায় গত বছরের ৯ নভেম্বর সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার নিয়োগের ফাইলও ফেরত আসে। মন্ত্রণালয় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনরায় ট্রেজারার নিয়োগের প্যানেল পাঠানোর অনুরোধ করেছে। কিন্তু ১০ মাস পার হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারার নিয়োগ হয়নি। এখন প্রো-ভিসি পদটিও খালি রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার খুঁজে পেতে গলদঘর্ম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ প্রতিটি পদের জন্য তিনজনের প্যানেল পাঠাতে হয়। আর তিনজনকেই সমযোগ্যতাসম্পন্ন হতে হয়। কিন্তু সাধারণভাবে যেহেতু এক নম্বরে থাকা ব্যক্তিকেই ওই পদের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। তাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বরে থাকতে কেউ নাম দিতে আগ্রহী হন না। আবার অবসরপ্রাপ্ত অনেক ভালো শিক্ষক থাকলেও ট্রাস্টি বোর্ডের কর্তৃত্বের কারণে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে অনীহা দেখান।

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার পদে তিনজনের প্যানেল পাঠাতে হবে। এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যোগ্য প্রার্থী খুঁজে না পায়, তাহলে তারা ইউজিসির সহায়তা নিতে পারে। তারা প্যানেলের চিঠিতে লিখতে পারে, তাদের প্যানেলে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি থেকে যে প্যানেল দেওয়া হবে তারা সেটা মেনে নেবে। তাহলে আমরাই প্যানেল করে দেব। আসলে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইচ্ছে করেই কালক্ষেপণ করে।’

শিক্ষকরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রো-ভিসিদের তেমন কোনো কাজ থাকে না। দু-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া ভিসি নিজেই প্রশাসনিক, অ্যাকাডেমিক সব ধরনের দায়িত্ব পালন করতে চান। ফলে প্রো-ভিসিদের বসে বসে সময় কাটানো ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো দায়িত্ব থাকে না। এতে এই পদে আসতে সবচেয়ে বেশি অনীহা দেখা যায়। এজন্যই ৮৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি পদ শূন্য রয়েছে।

সূত্র জানায়, ভিসি হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রথম শ্রেণি বা সমমানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অথবা পিএইচডি ডিগ্রি এবং কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যূন ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এর সঙ্গে গবেষণা ও প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞতা মিলিয়ে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। প্রো-ভিসি পদে ভিসি পদের মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হলেও ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। তবে ট্রেজারার পদে নিয়োগের জন্য ন্যূনপক্ষে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিসহ অন্যূন ১৫ বছরের অধ্যাপনা, প্রশাসনিক বা আর্থিক ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।

শিক্ষকরা বলেছেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগে প্রথমে ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে ইউজিসিতে প্যানেল পাঠাতে হয়। এরপর তারা তা যাচাই-বাছাই শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে তা রাষ্ট্রপতি দপ্তরে যায়। এরপর তা ফিরে এলে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে চললেও কয়েক মাস সময় লেগে যায়। তবে একটু ধীরগতি হলে তা বছর গড়িয়ে যায়।

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সহসভাপতি ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী বলেন, ‘অনেক ইউনিভার্সিটি। সেগুলোর প্রতিটিতেই ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার পদে তিনজনের প্যানেল পাঠাতে হয়। তাদের প্রত্যেকের যোগ্যতা প্রায় কাছাকাছি। এত নাম পাওয়া যাচ্ছে না। আর তিনজনের মধ্যে একজন হবেন, যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিশ্চিত থাকে। তাই বাকি দুজন কোনোভাবেই নাম দিতে চান না। এজন্য যদি একটা নাম সাজেস্ট করা যায়, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে। তাকে যদি যোগ্য মনে না হয়, তাহলে দ্রুত যেন ফাইল ফেরত পাঠানো হয়।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৩টি। গত ২৮ আগস্টের তথ্যানুযায়ী, ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, ৮৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি ও ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারের পদ শূন্য রয়েছে। এমনকি অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়েও দীর্ঘদিন ধরে পদগুলো শূন্য রয়েছে।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে প্রো-ভিসি, ট্রেজারার নেই, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশে ভিসি নেই, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে ট্রেজারার নেই, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে প্রো-ভিসি-ট্রেজারার দুটোই নেই, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ট্রেজারার নেই, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে ভিসি নেই, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে ভিসি নেই। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে ট্রেজারার নেই, উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে ট্রেজারার-প্রো-ভিসি দুটোই নেই, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস ও প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভিসি নেই। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ট্রেজারার-প্রোভিসি নেই, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সের ভিসি-প্রোভিসি নেই। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, চিটাগং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, মানিকগঞ্জের এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটিতে ভিসি-প্রোভিসি-ট্রেজারার কোনোটিই নেই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী, একটি বিশ^বিদ্যালয়ে ৯ ধরনের কমিটি থাকতে হয়। এর মধ্যে তিনটি কমিটির সভাপতি থাকেন ভিসি। তিনটি কমিটিতে ভিসি মনোনীত শিক্ষক সভাপতি হন। আর বাকি তিনটি কমিটিতে সভাপতি থাকেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা। এই তিন কমিটিতেও সদস্য হিসেবে থাকেন ভিসি আর একটিতে ট্রেজারারের থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আর্থিক লেনদেন পরিচালিত হয় ভিসি ও ট্রেজারারের স্বাক্ষরে। অথচ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার না থাকলেও তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে আর্থিকসহ নানা বিষয়ে অস্বচ্ছতা দেখা দিয়েছে।

ইউজিসি বলছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি ও ট্রেজারার পদ শূন্য থাকলেও তারা সে ব্যাপারে তেমন কোনো তাগিদ বোধ করছে না। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা নিজেদের ইচ্ছেমতো কাউকে ভারপ্রাপ্ত রেখে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে প্যানেল পাঠানো হয়। তাই বাতিল হয়ে যায়। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানেল প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারারের মেয়াদ পূর্তির তিন-চার মাস আগে তাদের প্যানেল প্রস্তাব প্রস্তুত করে তাহলে কোনো পদই শূন্য থাকবে না।

তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, প্যানেল পাঠানোর পর সব প্রক্রিয়া শেষে প্রজ্ঞাপন জারি হতে অনেক ক্ষেত্রে এক বছরও সময় লেগে যায়। ফাইল পাঠানোর পর দীর্ঘসময় কেন অপেক্ষা করতে হয় এবং এত দীর্ঘসূত্রতা কোথায় সেটাও চিহ্নিত করা দরকার। যদি সমযোগ্যতাসম্পন্ন না পাওয়ায় তাহলে কালক্ষেপণ না করে দ্রুতই যেন তা ফেরত পাঠানো হয়।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৩/০৯/২০২৩     

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়