বেতন নিচ্ছেন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা, প্রক্সি শিক্ষকরা নিচ্ছেন ক্লাস

কুড়িগ্রামঃ জেলার নাগেশ্বরীতে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের অনিয়মে ভেঙে পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থা। উপজেলার ছয়টি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের অধিকাংশই ভাড়াটে শিক্ষক বা প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে চলছে।

অথচ দিনের দিন পর এসব বিদ্যালয়ে উপস্থিত না থেকেও নিয়মিত বেতন ভাতা তুলছেন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা, হাজিরা খাতায়ও তাদের নাম উঠছে নিয়মিত।

অভিভাবকরা বলছেন, এতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে। এ নিয়ে কেউ কথা বলতে যান না। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অভিযোগ দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ছয়টি বিদ্যালয়ের মধ্যে দুটি বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গত কদিন ধরে এমন চিত্র দেখা গেছে। অন্যগুলোতে খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেছে অনিয়মের চিত্র।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার চর নুনখাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উড়ছে জাতীয় পতাকা। রোজই এই চিত্র দেখা যায়।

কিন্তু বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষসহ শিক্ষকের অফিস কক্ষ তালাবদ্ধ। শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিলগুলো এলোমেলা ভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে কক্ষজুড়ে। জানালাগুলোতেও মাকড়সা তার জালে ছড়িয়ে দিয়েছে নিশ্চিন্তে। শ্রেণিকক্ষে ধুলোর আস্তরণ জমেছে। দেখে মনে হয় না চলমান একটি বিদ্যালয় এটি।

স্থানীয়দের অভিযোগ প্রায় ৮মাস ধরে এই বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকায় গো চরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে স্থানটি। নিয়মিত বিদ্যালয়ে না এসেও হাজিরা খাতায় নিয়মিত বিদ্যালয়ের চাজন শিক্ষক। স্থানীয় শিক্ষা বিভাগকে ম্যানেজ করে বেতন ভাতা তুলছেন তারা অনায়সেই। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রভাবশালী মহলের আত্মীয় হওয়ায় বিদ্যালয় আসা বা না আসা চলে তাদের খেয়াল-খুশি মতো।

এতে বিদ্যালয়ের দুই শতাধিকেরও বেশি শিক্ষার্থীরা এখন সরকারি পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় চালু না থাকায় শিক্ষার্থীরা অনেকে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছেন আবার অনেকেরই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে।

নাগেশ্বরী উপজেলার চর নুনখাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

নদী ভাঙনের শিকার হয়ে এখন কোনো রকমে একটি ছাপড়া তুলে চলছে পাঠদান। তবে এই বিদ্যালয়ের তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর পাঠদান করছেন মাত্র দুইজন শিক্ষক। তবে তারা কেউই নিয়োগপ্রাপ্ত নন। বরং ভাড়াটিয়া বা প্রক্সি শিক্ষক তারা। প্রতিমাসে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিনিময়ে প্রক্সি শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। অথচ বিদ্যালয়ের ৪জন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক জেলা শহরসহ ঢাকায় অবস্থান করলেও শিক্ষক হাজিরা খাতায় তারা উপস্থিতি নিয়মিত।

অন্যদিকে বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা প্রক্সি শিক্ষক ছাড়া অন্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চেনেও না।

অভিভাবকদের অভিযোগ

স্থানীয় অভিভাবক গোলজার হোসেন বলেন, ‘আমাদের চর নুনখাওয়া সরকারি স্কুল ৭ থেকে ৮মাস ধরে বন্ধ। শুধু প্রতিদিন জাতীয় পতাকা তোলা হয়। কোনো শিক্ষক আসে না এখানে। তাই বাচ্চারাও স্কুলে যায় না। সরকারি স্কুল বন্ধ থাকায় এলাকার যারা একটু বিত্তবান তারা টাকা দিয়ে শিক্ষক রেখে কোচিং করিয়ে সন্তানদের শিক্ষিত করছে। কিন্তু আমাদের উপায় কী?’

আরেক অভিভাবক আমিনা বেগম বলেন, ‘প্রায় ৮মাস ধরে সরকারি স্কুল বন্ধ। এলাকার বাচ্চারা পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হলেও কারও কোনো উদ্যোগ নেই এ নিয়ে। সরকারি মাস্টাররা তো ঠিকই সরকারের বেতন ভাতা নিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের সন্তানদের কী হবে?’

এরশাদ হক নামের আরেক অভিভাবক বলেন, ‘স্থানীয় শিক্ষা বিভাগ সব জানে কারা কারা স্কুল আসেন আর কারা আসেন না। তবুও কোনো ব্যবস্থা নেয় না কর্তৃপক্ষ। কারণ যেসব শিক্ষক এই বিদ্যালয় গুলোতে চাকুরি করেন তারা কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আবার কেউ প্রভাবশালী মহলের স্বজন। তাই তারা কী করলো বা কী করলো না, তা নিয়ে কেউ কথা বলতে যান না।’

রিপন আহমেদ নামের এক স্থানীয় বলেন, ‘আমাদের যাত্রাপুরে দলীয় কিংবা প্রভাবশালী মহলের স্বজনরা শহরের স্কুল থেকে বদলি নিয়ে এসে প্রত্যন্ত এলাকায় যোগদান করেন। এরপর আর তারা স্কুলে শিক্ষকতা করেন না। প্রক্সি শিক্ষক বা ভাড়াটিয়া শিক্ষক দ্বারা এসব স্কুল চলে। এই প্রক্সি শিক্ষকের কোনো প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা নেই। তারা কী শিক্ষা দেবে শিশুদের। এসব বিশৃঙ্খলার জন্যই আমাদের এলাকায় শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ পড়েছে।’

স্কুলের আরেক অভিভাবক মিনা বেগম বলেন, ‘সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা তো আসেন না নিয়মিত। প্রক্সি মাস্টারও নিয়মিত ক্লাস নেন না। যেদিন চেয়ারম্যান, মেম্বার বা কোনো অফিসার আসেন স্কুলে, সেদিন করে প্রক্সি শিক্ষকরা ক্লাস নেন। সেটাও দুই থেকে তিন ঘন্টা। কোনোদিন ফুল ক্লাস হয় না আমাদের এলাকার স্কুলে। স্কুল না এসেও কীভাবে প্রতিদিন হাজিরা খাতায় উপস্থিত থাকেন তারা শুধু তারাই বলতে পারবেন।’

বরি চান মিয়া বলেন, ‘প্রভাবশালী মহলের স্বজনরা শিক্ষকতার চাকুরি নিয়ে এসব বিদ্যালয়ে যোগদান করে ঠিকই। কিন্তু তারা আর স্কুল আসেন না। বছরের পর বছর তারা অনুপস্থিত থাকেন। স্থানীয় শিক্ষা বিভাগের নজরে থাকলেও কোনো পদক্ষেপ নেয় না বিভাগটি। এমন শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসনের সবাই জানে। কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ নেন না।’

শিক্ষকদের বক্তব্য

চর ভগবতিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমির হোসেন বলেন, ‘আমাদের স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি যেসব ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে তারা এখনও বানান, রিডিং, উচ্চারণ, হাতের লেখা এগুলো পারে না। যে বিষয়গুলো প্রাইমারিতে শেষ করার কথা সেগুলো এখন আমাদেরকে শেখাতে হচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার প্রাইমারি শিক্ষাব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে।’

প্রক্সি শিক্ষক মৌসুমি আক্তার বলেন, ‘আমি সাড়ে তিন হাজার টাকায় নিয়মিত প্রক্সি শিক্ষক হিসেবে ঝুনকার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস নেই। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শহরে এবং ঢাকায় থাকেন। স্কুলের শিক্ষকরা হাজিরা কীভাবে দেন আমরা তা জানি না। এই বিষয়টি স্কুলের সভাপতি জানেন। আমরা তার মাধ্যমে এখানে প্রক্সি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি।’

কর্তৃপক্ষ কী বলছে?

বিদ্যালয় নিয়মিত না খোলার অভিযোগ অস্বীকার করে চর নুনখাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান খান জুয়েল বলেন, ‘কিছু অভিভাবক এবং বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিকে সরকারের বরাদ্দ টাকার কমিশন না দেয়ায় এমন মিথ্যা অভিযোগ করেছে।’

যাত্রাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর গফুর বলেন, ‘নদী পার হয়ে ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সবগুলোতে প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস চলে। নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য যদি সরকারি ভাবে নৌকার দিয়ে চলাচলের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে শিক্ষকরা প্রশাসনের নজরদারির মধ্যে আসবে এবং শিক্ষকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।’

এই বিষয়ে জেলার শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কোনো বক্তব্য না দিলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রক্সি শিক্ষক দ্বারা পাঠদান করার কোনো নিয়ম নেই। এছাড়াও প্রভাবশালী মহলের স্বজন যারা বিদ্যালয় যায় না অভিযোগ দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে তাদের বিষয়ে।’ সূত্রঃ নিউজ বাংলা

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৮/১০/২০২৩   

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়