শিক্ষাবার্তা .ডেস্ক, ঢাকাঃ রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। গত কয়েক দিনে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় বিষয়টি আবারও সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। সাধারণত হতাশা, আর্থিক অভাব এবং পরিবারের চাপসহ নানা কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
২০২২ সালে সারা দেশে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৫৩২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদের মতে, মানুষের কোনো সমস্যা স্থায়ীভাবে শেষ হওয়ার নয়। এ জন্য আত্মহত্যা সমাধান হতে পারে না। বরং কোনো সমস্যাকে বড় মনে না করে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে নিজেকে মানিয়ে সামনে এগিয়ে চলার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. এএসএম আমানুল্লাহ বলেন, বর্তমান সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, যা মানুষের মনে আঘাত করছে। এর ফলে মানুষের মনে নৈরাজ্যজনক অবস্থা কাজ করছে। বিশ্বায়নের ফলে সমাজ কাঠামো ভেঙে এক স্টেজ থেকে নতুন স্টেজে রূপ নিচ্ছে। এর সঙ্গে অনেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে, তাল মেলাতে না পেরে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে।
এই সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, আত্মহত্যা পুরোপুরি প্রতিরোধ করা যায় না, তবে আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ সর্বক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা বা টেকনিকগুলোর অভাব রয়েছে। কোথাও এ ধরনের টেকনিক শেখানো হয় না। অন্যদিকে কেউ এক দিনে আত্মহত্যা করে না। দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রক্রিয়ায় আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার লক্ষণগুলো বুঝতে পেরে আগে থেকে উদ্যোগ নিয়ে যথাযথ কাউন্সেলিং করা গেলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা গেছে, ২১ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের শিক্ষার্থী শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম নিজ কক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। রুমমেট ও হলের বন্ধুদের কাছ থেকে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে অর্থনৈতিক সমস্যা ও হতাশায় ভুগছিলেন মঞ্জুর। কিন্তু এর জন্য আত্মহত্যা করবেন এমনটি বুঝতে পারেননি কেউ। ১৯ আগস্ট ঋতুপর্ণা কর্মকার (২৬) নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
ঋতুর ভাই বিজয় কর্মকার বলেন, লেখাপড়া শেষে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি না পাওয়ায় তার ভেতরে হতাশা কাজ করছিল। এ ঘটনার কয়েক দিন আগে ১৬ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজের আবাসিক হলে জয়া কু- (২৪) নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। ওই শিক্ষার্থীর রুমমেট পৃথুলা রায় বলেন, অনেক দিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন জয়া। বিভিন্ন জায়গায় তাকে কাউন্সেলিং করানো হচ্ছিল। ওপরের তিনটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অর্থনৈতিক সমস্যা, পড়াশোনা শেষে যথাসময়ে চাকরি না হওয়া ও হতাশা থেকে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শাহীন মোল্লা বলেন, বয়সভেদে আত্মহত্যার কারণ ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হতাশা, যথাসময়ে চাকরি না পাওয়া, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, বেকারত্ব, পারিবারিক চাপ, প্রেমঘটিত জটিলতা, নিঃসঙ্গতা, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হওয়া, ফল আশানুরূপ না হওয়া ও মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি।
তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত কাউন্সিলর নেই। প্রতিটি হলে কাউন্সেলিং করানোর ব্যবস্থা থাকলে প্রবণতা অনেক কমবে। তিনি বলেন, এক বন্ধু অন্য বন্ধুদের সমস্যার বিষয়ে সবথেকে ভালো জানেন। এ ক্ষেত্রে কেউ স্বেচ্ছায় কাউন্সেলিং করাতে না চাইলে তাকে হলের কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে যেতে পারে। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল পর্যায়ে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধে কাউন্সেলিং বাড়াতে হবে।
গত কয়েক বছরের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া বুয়েট এবং ঢাকা মেডিকেলসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, ২০২২ সালে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৫৩২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ৪৪৬ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ২০২১ সালে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১০১ জন। এ ছাড়া ২০২০ সালে ৪২, ২০১৯ সালে ৫৬, ২০১৮ সালে ১১, ২০১৭ সালে ১৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর ১৩-১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে।
আত্মহত্যার পেছনের কারণ উল্লেখ করে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, অভিমান করে আত্মহত্যার প্রবণতা সবথেকে বেশি। ২৭.৩৬ শতাংশ স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী অভিমান করে আত্মহত্যা করেছেন। দেখা গেছে, বেশিরভাগ অংশ পরিবারের সঙ্গে অভিমান করেছেন। অন্যান্য কারণের মধ্যে- প্রেমঘটিত কারণ যা ২৩.৩২ শতাংশ, পারিবারিক কলহ ৩.১৪ শতাংশ, হতাশাগ্রস্ততা ২.০১ শতাংশ, মানসিক সমস্যা ১.৭৯ শতাংশ, আর্থিক সমস্যা ১.৭৯ শতাংশ, উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথে ধাবিত হয়েছেন ৩.১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। আরও কিছু কারণের মধ্যে আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ায় ৪ জন, শিক্ষক কর্তৃক অপমানিত হয়ে ৬ জন, গেম খেলতে বাধা দেওয়ায় ৭ জন, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ২৭ জন, মোবাইল ফোন কিনে না দেওয়ায় ১০ জন এবং মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় ৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এ ছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল না পাওয়া, পড়াশোনার চাপ অনুভব করা এবং পারিবারিক চাপে আত্মহত্যা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আত্মহত্যাকারী স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। ২০২২ সালে ৬৩.৯০ শতাংশ নারী এবং ৩৬.১ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। শুধু স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যাকারী নারী শিক্ষার্থীর পরিমাণ ৬৫.৩০ শতাংশ এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৩৪.৭০ শতাংশ। অন্যদিকে শুধু কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননকারী নারী ৫৯.৪৪ শতাংশ এবং পুরুষ ৪০.৫৬ শতাংশ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে চার বছর ধরে চাকরির চেষ্টা করা আবিদ রহমান পলাশ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা থেকে চাকরির পড়াশোনা আলাদা। স্নাতকোত্তর শেষে দুই থেকে তিন বছর পড়াশোনার পর একাধিকবার ভাইভা দিয়ে চাকরি না পেলে হতাশা কাজ করে। আবার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে পরিবারের অনেক প্রত্যাশা থাকে। একদিকে হতাশা ও অন্যদিকে পরিবারের চাপের কারণেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, বিষণœতা, পারিবারিক চাপ, আর্থিক অসঙ্গতি ও প্রেমের কারণে বেশিরভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
তার মতে, কোনো সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান করা যায় না। এ ক্ষেত্রে অনেকে সমস্যাকে বড় মনে না করে নিজেকে মানিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। যারা পারে না তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবাই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে আত্মহত্যার প্রবণতা কমবে। সূত্রঃ সময়ের আলো
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৩/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়