বেকার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে করণীয় কী

ওয়াসি মাহিনঃ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আমেরিকার মতো নয়। সেটা আশা করেও লাভ নেই। আর এজন্য যেটুকু সময় শিক্ষা ব্যবস্থাকে গালি দিতে ব্যয় করবেন সেই সময়টুকু নিজের আত্মউন্নয়নে ব্যয় করুন। কেন বলছি এই কথা? আমার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের গল্প শেয়ার করি। ঢাবির হলে থাকতেন। বাড়ি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমি নাম বলছি না।

এদেশের মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে পাস করে ভর্তি পরীক্ষায় বি ইউনিটে ইংরেজিতে সর্বোচ্চ ৩০ এর ভেতর ২৯টি সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন। সেই সময়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন এতো সহজ হতো না। তার একটাই ইচ্ছা ছিল যে তিনি ঢাবিতে ইংরেজি বিষয়ে পড়বেন। কিন্তু সাবজেক্ট চয়েজের সময় ইংরেজিতে এতো বেশি মার্ক দেখে তাকে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে ভর্তির ইচ্ছা শুনেই সাত পাঁচ না ভেবেই ভাইভা বোর্ড রাজি হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই দেখা দেয় ঝামেলা। মাদ্রাসা সিস্টেমে ইংরেজি ১০০ মার্কের ছিল। জেনারেল লাইনে প্রথম এবং দ্বিতীয় পত্র মিলিয়ে ২০০ নম্বর। এ কারণেই তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইংরেজি বিষয়ে তিনি ভর্তি হতে পারেননি। ভর্তি পরীক্ষার সর্বোচ্চ ইংরেজি নাম্বার তার কাজে আসেনি। জানি না ঢাবিতে এই নিয়ম এখন পরিবর্তন হয়েছে কিনা। শুধু তার আক্ষেপ একদিন শুনেছিলাম। তিনি বলতেন তিনিও son of this soil। কিন্তু তিনি বৈষম্যের শিকার হলেন। ইংরেজি বিষয়ে তিনি নিজ ইচ্ছায় নিজেকে এতটায় দক্ষ করেছিলেন যে আমরা তাকে বলতাম চলন্ত ডিকশনারি। আমি কখনো দেখিনি কোনো শব্দের বাংলা জিজ্ঞেস করাতে তিনি ডিকশনারির সাহায্য নিয়েছেন। বিসিএস দেননি। তার সফলতা তাকে এখন ইউরোপের নামি দেশে পিএইচডি করার সৌভাগ্য করে দিয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তার আক্ষেপ ছিল। কিন্তু তিনি এই ব্যবস্থাকে সারাদিন গালি দিয়ে সময় নষ্ট না করে নিজেকে এমন স্থানে নিয়ে গেছেন যে হয়তো এদেশের ভার্সিটি তাকে ধারণ করতে পারবে না। এটা আমার বিশ্বাস।

আর এজন্যই আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে নিজের দক্ষতার উন্নতির জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী হোন। মনে রাখবেন আপনি নিজেকে যদি যোগ্য করতে পারেন তবে অবশ্যই চাকুরীর পিছে আপনি ছুটবেন না। বরং উল্টাটি হবে। আর যদি মনে করেন আমি ক্যাম্পাসিয়ান, আমি প্রাইভেটিয়ান, আমি অমুকিয়ান, আমি তমুকিয়ান, তাহলে দেখবেন নিজের গুরুত্বপূর্ণ সময় এসব করে কাটিয়ে অবস্থা এমন হবে আপনার নামের পাশে, এমবিএ, এমএসসি এরকম অনেক ডিগ্রি ঝুলবে। কিন্তু দক্ষতার বিচারে আপনি নিজেই অনুধাবন করবেন আপনি যোগ্য নন। দেখবেন ভাইভাতে কথা বলার মতো দক্ষতাও এতো বছরের ছাত্র জীবনে আপনি অর্জন করতে পারেননি। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট শিখেননি। পিপল ম্যানেজমেন্ট শিখেননি। নিজেকে ঠকিয়ে লাভ নেই। ফেসবুকে বেকারত্ব অভিশাপ বলে কপাল না চাপড়িয়ে আসুন নিজেদের আমরা নিজেরাই গড়ে তুলি।

এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন কাজ কখনো ছোট না। কে কী বলবে এই আশায় বসে থাকবেন না। আর অবশ্যই আপনি আইবিএতে পড়েন, আপনি অমুক প্রাইভেটে পড়েন এজন্য শুধু জব করতেই হবে এমন ভাববেন না। ক্রিয়েটিভিটি বৃদ্ধি করুন। বিশ্বাস করুন, বিশ্বের সব থেকে সফলরা চাকরি করে সফল হয়নি। তারা তাদের ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে সফল হয়েছে। জুকারবার্গ ফেসবুক বানিয়ে আপনার আমার মতো লক্ষ মানুষকে টাকার বিনিময়ে খাটাচ্ছে। আর আপনি খেটে গর্বিত হচ্ছেন। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড সহ সেরা বিশ্ববিদ্যায়লের ছাত্রদের ঝোঁক কোনোদিকে একটু খেয়াল করেন। তারা স্টার্টাপ করে সফল। নতুন ধারণা, ব্যবসা সব তাদের মাধ্যমেই। খুব কী ক্ষতি হবে যদি আপনি নিজের মন থেকে চাকরি করার চিন্তাকে স্থায়ী রূপ না দিয়ে একটি অপশন হিসাবে রাখেন? কী হতে পারতো আমাদের দেশের ভার্সিটিগুলাতে। প্রথম বর্ষে ঢুকেই র‌্যাগিং, ফুর্তি, প্রেম, আড্ডা, সিগারেট ফুঁকা, ক্রাশ খাওয়া, মেমে বানানো, এসব অবান্তর কাজের ফাঁকে যদি আপনার বন্ধু মহল মিলে নতুন কিছু করার প্রত্যয় করতে পারেন বিষয়টি কী খারাপ হতো? পড়েন বিজনেস স্টাডিজে অথচ বাস্তব ব্যবসায়ীদের ১০ শতাংশও ধারণা রাখেন না ব্যবসা সম্পর্কে। গ্রাজুয়েট হয়ে আপনার লাভ কী? টিউশনি করুন। বাড়ি থেকে পাঠানো টাকার অল্প অল্প সঞ্চয় করুন। দশ বিশ হাজার হয়ে গেলে কয়েকজন বন্ধু মিলে শুরু করে দিন নতুন কিছু। অথবা পুরাতন কিছুকে নতুন ভাবে। ছাত্র অবস্থায় নিজেকে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে উঠার এই শিক্ষা পুস্তকে থাকলেও সেটার বাস্তবায়ন করার ইচ্ছাশক্তি আপনার থাকতেই হবে। সেদিনের পাঠাও এখন হাজার কোটি টাকার কোম্পানিতে রূপ নিয়েছে। ছাত্র অবস্থায় স্বপ্ন, আইডিয়া এগুলোর পিছনে অল্প হলেও সময়, শ্রম দিন। দেখবেন প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ বিবিএ, এমবিএ বের হয়ে চাকরির জন্য পথ চেয়ে বসে না থেকে অন্যের চাকরি সৃষ্টি করার সুযোগ সৃষ্টি আপনারাই করতে পারবেন।

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন ইন্টারনেট এতো সহজলভ্য ছিলো না। একটি তথ্য যোগাড় করতে আপনাদের ৫ সেকেন্ড লাগে। আমাদের সময়ে আমরা একটি তথ্য খুঁজে পেতে লাইব্রেরিতে গিয়েছি। মাসের পর মাস গেছে। অনেক ক্ষেত্রে কয়েক বছর লেগেছে শুধু একটি তথ্য পেতে। ভার্সিটিতে যখন পড়ি গুগল তখন আজকের মতো ছিল না। এমনকি আমরা চিনতামও না। আমরা চিনতাম ইয়াহু। মজিলা, ক্রোম এগুলোর অস্তিত্ব তখন ছিলোনা। কখনো ভাবিনি ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার এর বিকল্প কিছু আসতে পারে। প্রথম কম্পিউটার স্পর্শ করার অভিজ্ঞতা কলেজে উঠে।

আর এখন আপনারা পিচ্চিকাল থেকে ওই আমলের কম্পিউটার হতে শত গুন শক্তিশালি কম্পিউটার হাতে করে ঘুরেন। পকেটে রাখেন। নিজের জ্ঞানের পরিধী যদি এতো কিছুর পরও না বাড়াতে পারেন তাহলে অন্যের উপর দোষ চাপাবেন না। দোষ আপনার নিজের। অহেতুক সময়গুলো নষ্ট করছেন কোন নায়িকা কী করেছে, কার সম্পর্ক টিকে নায়, পর্ণ দেখতেছেন। ফেসবুকে দুনিয়ার যত আকাজের জিনিস আছে ওগুলো আপনার কাছে ততো জনপ্রিয়। অথচ আপনি চাইলেই আপনার ফেসবুক অন্যরকম হতে পারতো। বিভিন্ন দেশের নামকরা পত্রিকাগুলোর ফলোয়ার হয়ে সারা দুনিয়ার তথ্যে ঠাসা হয়ে থাকতে পারতেন। গবেষণা, নতুন থিওরি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, কী জানতে চান সব জানার সুযোগ আপনার সামনেই আছে। শুধু নেই আপনার আগ্রহ।

কারিগরি শিক্ষার কথা বলবেন অনেকে। বিশ্বাস করুন, আপনাদের মতো এতো প্রযুক্তির সুবিধা আমাদের কাছে ছিল না। কিন্তু আমি কারিগরি কোনো সমস্যায় পড়লে ইউটিউবকে ব্যবহার করি। হতে পারে ক্যামেরা লেন্সের ডাস্ট পরিষ্কার করার নিয়ম, হতে পারে অন্য কিছু। আপনার কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে আপনি পড়ে যতটুকু বুঝবেন তার থেকেও শত গুণ ভালো বুঝবেন ভিডিও ডেমনস্ট্রেশন দেখলে। অথচ আপনারা সেখানেও আকাজে সময় নষ্ট করেন।

তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। মনে রাখবেন আপনার থেকে হাজার গুণ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অনেকেই উঠে আসে। সফল হয়। ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে। নিজের শিক্ষার পাশাপাশি অন্তত পক্ষে লক্ষ্য নির্ধারণ করুন কমপক্ষে ২/৩টি বিষয়ে আপনি নিজেকে দক্ষ করে তুলবেন। হোক সেটা ভাষা দক্ষতা। হতে পারে প্রতিদিন একজন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবার লক্ষ ঠিক করছেন। এতে আপনার পিপল ম্যানেজমেন্ট স্কিল বাড়বে। যেভাবেই পারেন আসুন আমরা শ্রেষ্ঠ একটা জাতিতে নিজেরা রূপান্তরিত হই। চাবি আপনার নিজের হাতে। অন্য কারো হাতে নয়।

লেখক: ব্যাংকার

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৬/০৯/২০২৩     

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়