বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা শিক্ষকতার চেয়ে রাজনীতিতে ব্যস্ত বেশি

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ফজলুল করিম আমার অফিসে এসেছিল একটু গল্প করতে। আসার আগে ফোন করে জেনে নিয়েছিল আমি অফিসে আছি কিনা। ফজলুল করিম জাপান থেকে পিএইচডি করে আমেরিকার University of Pittsburgh-এ পোস্টডক করে দেশে ফিরেছে। দীর্ঘসময় গল্প করেছি। তবে পুরোটা সময়ই শিক্ষা আর গবেষণা নিয়েই আলোচনা। হঠাৎ ইচ্ছে হলো আলোচনার বুলেট পয়েন্টসগুলো লিখে রাখি।

বলছিলাম, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন যে যেই বিষয় পড়ায় সেই কোর্সের প্রশ্ন করতে, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে পারিতোষিক নেয় কেন? কেন পরীক্ষার হলে ইনভিজিলেশন দেওয়ার জন্য বাড়তি অর্থ নেই? কেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগে কোনো কোর্স পড়ালে পার্ট-টাইম শিক্ষক হিসাবে বাড়তি বেতন নেই?

অর্থাৎ যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই আমি আবার পার্ট-টাইম শিক্ষক। এসব তো অনেক আগে ছিল না। পৃথিবীর সভ্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও নাই। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশের শিক্ষক জীবিকার জন্য নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ১ বা একাধিক জায়গায় পার্ট-টাইম পড়ায়? পৃথিবীর এমন কোনো দেশ আছে যেই দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের ৪ গুণ? শুধুই কি বিশ্ববিদ্যালয়ে? স্কুল কলেজেও ঘটছে। স্কুল কলেজের শিক্ষকরাও নিজ স্কুল কলেজের শ্রেণীকক্ষে পড়ানোর সময় ইচ্ছে করে খারাপ পড়াবে যেন ছাত্রদের মধ্যে তার কাছেই অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়তে আসে। যারা পড়বে না তাদের পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়ার নজিরও আছে।

প্রশ্ন হলো এইসব কেন হচ্ছে। প্রথমত এইসব কিছুই হঠাৎ করে একদিনে হয়নি। বহু বছর ধরে শিক্ষকেরা বেতনে অর্থে বঞ্চিত হতে ছিল কিন্তু সমাজ আস্তে আস্তে পুঁজিবাদে বদলে যাচ্ছিল। তারা এই কম বেতনে চলতে পারছিল না। শুরু হয়েছিল অল্প বিস্তর আয়ের জন্য একটু আধটু কিছু করা। করতে করতে বিবর্তনের ধারায় আজকে এমন একটি জায়গায় এসে গেছে যে শিক্ষকরাই এখন সমাজের সবচেয়ে অনৈতিক কাজ করে। যারা অনৈতিক কাজ করে তারা কিভাবে নৈতিকতার শিক্ষা দেবে? দেশে যে আজ অসৎ মানুষে সয়লাব হয়ে যেতে দেখছেন এ তারই ফসল। শিক্ষকেরা অনৈতিক বিধায় শিক্ষকরা এখন সমাজে আর সম্মানের উচ্ছ্বাসনে নেই। পরীক্ষায় নকল করতে না দেওয়ায় শিক্ষকদের ধরে ছাত্ররাই মারে। বিজ্ঞানের কথা বলতে গেলে ধর্মের দোহাই দিয়ে গলায় জুতার মালা পড়ায়।

সারা পৃথিবী জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা পত্র রিভিউ করে এবং শিক্ষকরা তার জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেয় না। শিক্ষকরা জার্নালের এডিটর হয়ে অমানসিক পরিশ্রম করে কিন্তু এই কাজেরও পারিশ্রমিক নেন না। আমরা ছাত্রদের গবেষণা সুপারভাইস করি। সবাই সমান করি না। এজন্য শিক্ষকদের মধ্যে যারা সুপারভাইস করেন তারা বলেন না তাকে পারিশ্রমিক দিতে হবে। গবেষণপত্র বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষকরা রিভিউ করে বলেই একে পিয়ার রিভিউ আর্টিকেল বলে। পিয়ারদের গবেষণাপত্র রিভিউ করতে টাকাপয়সা না নিলে পিয়ারদের নিয়োগ বোর্ডে থেকে কেন টাকা নেবো? আমি কয়েকটি নিয়োগ বোর্ডে ছিলাম। ইন্টারভিউ এর পরে যখন এনভেলাপে করে টাকা দিত খুবই বিব্রত হতাম এবং নিতে অস্বীকৃতি জানতাম। অস্বীকৃতি জানিয়ে টাকা না নেওয়াও আরেক বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কারণ আমার অন্য সহকর্মী যারা বোর্ডের সদস্য তাদেরকে লজ্জা দেওয়া হয়। যার জন্য আমি এখন আর কোনো নিয়োগ বোর্ডের সদস্য হই না।

এসব কিছুর মূলে হলো শিক্ষকদের কম বেতন দেওয়া। প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এত কম বেতন বিশ্বের আর কোন দেশে পাবেন না। আমাদের পাশের দেশ ভারতের কথা ভাবুন। সেখানকার বিশ^বিদ্যালয় পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বত্র বেতন আমাদের দ্বিগুণের বেশি। অথচ সেখানে জিনিসপত্রের দাম প্রায় অর্ধেক বা অনেক কম। শিক্ষকরা তো কেউ বড়লোক হওয়ার জন্য এই পেশায় আসে না। এই পেশার আনন্দ হলো সারা জীবন লেখাপড়া করে নিজেকে জ্ঞানের প্রবাহে রাখা যায়। এই পেশার আনন্দ হলো মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের বয়সের মানুষদের সাথে থাকা যায়। শিক্ষকদের জন্য একটা আলাদা বেতন স্কেল করে দিলেই কেবল দেশে সৎ মানুষ তৈরির যাত্রা আবার নতুন করে শুরু হবে। অন্য সকল পেশায় ধান্দাবাজি করার ক্ষতি আর শিক্ষকতা পেশায় ধান্দাবাজি করার ক্ষতি এক না। আজকের বাংলাদেশের সমাজের যত সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন তার মূলে হলো শিক্ষকদের নষ্ট হয়ে যাওয়া। শিক্ষকদের সৎ ধান্দাবাজিহীন জীবন চালনা করার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

শিক্ষকদের ভালো বেতন দিলে শিক্ষকেরা পারিশ্রমিকহীন অনেক কাজ করবে। সেই কাজের মাধ্যমে শিক্ষকরা সমাজের সম্মান অর্জন করবে। তখন শিক্ষক ও ছাত্রের মাঝে সম্মানের একটা ঢাল তৈরি হবে। পানির প্রবাহের জন্য যেমন ঢাল লাগে ঠিক তেমনি শিক্ষক থেকে ছাত্রের মাঝে জ্ঞান প্রবাহের জন্য ঢাল লাগে। আজকে এই ঢাল নাই। শিক্ষকদের নৈতিকতা আজ তলানিতে। যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা শিক্ষকতার চেয়ে রাজনীতিতে ব্যস্ত বেশি/সরকারও কিছু বলে না কারণ তারাও এর থেকে লাভ দেখে। কিন্তু ক্ষতি তো হচ্ছে দেশের। সেইটা দেখার কেউ নাই। এসব ড. ফজলুল করিমের সাথে বলছিলাম। অন্তত ও আমার প্রতিটি কথার সাথে একমত পোষণ করেছে এবং যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল আজকের আলোচনার সারাংশ যেন লিখে রাখি।

লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/০৯/২০২৩

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়