বিনামূল্যের বইয়ের খরচ বাড়লেও মান কমেছে

শিক্ষাবার্তা ডেস্ক।।

বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের নতুন বই তুলে দেয় সরকার। নতুন বই পাওয়ার আনন্দে লেখাপড়ায়ও ছাত্র-ছাত্রীদের ঝোঁক বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোতে উপস্থিতি বেড়েছে কমেছে ঝরে পড়ার হার। তবে গতবছর কাগজ সংকট, বিদ্যুতের ঘাটতি ও ছাপাখানা মালিকদের নানা অজুহাতে বইয়ের মান কমেছে। নিম্নমানের কাগজ আর বাঁধাইয়ের কারণে বছর না পেরোতেই খুলে গেছে সেসব বইয়ের পাতা।

অথচ উল্টো চিত্র দেখা গেছে বইয়ের বরাদ্দ ও দামের ক্ষেত্রে। প্রাথমিকের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য ২০২২ সালের বইয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৭৭ কোটি টাকা। চলতি বছরে বইয়ের বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৯ কোটি টাকায়। আগামীবছরের জন্য বিনামূল্যের বইয়ের বরাদ্দ বেড়ে ৪০৬ কোটি টাকায় ঠেকেছে। অর্থাৎ তিন বছরে প্রাথমিকের বই ছাপাতে খরচ বেড়েছে ২২৯ কোটি টাকা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে বছর বছর শত কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ বাড়লেও বইয়ের মান কেন কমছে?

বই মুদ্র্রণের সঙ্গে জড়িত ছাপাখানার মালিকরা বলছেন, কাগজের দাম, মুদ্রাস্ফীতি ও বই ছাপানোর কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার অংক বেড়েছে। বই ছাপানোর কাজ পেতে প্রাক্কলিত দামের চেয়ে কম টাকায় কাজ নেওয়ায় মান খারাপ হচ্ছে। এছাড়াও পরিদর্শনের অভাব, জবাবদিহিতা না থাকা ও ছাপাখানাগুলোর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নেওয়ায় বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন পরিদর্শন দল। বই উৎপাদনকালে ছাপাখানাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করতে ৩ স্তরের পরিদর্শক দল কাজ করে। প্রাথমিকের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিদর্শক দল, মাধ্যমিকের জন্য এনসিটিবির পরিদর্শক দল এবং দরপত্রের মাধ্যমে একটি তৃতীয় পক্ষের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ছাপাখানা পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এনসিটিবি কর্মকর্তা ও মুদ্রণ মালিকদের একাংশের দাবি, পরিদর্শকদের অনিয়মের কারণেই নি¤œমানের বইগুলো অনুমোদন পেয়ে যায়।

বইয়ের মানের বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম তৃতীয় পক্ষের পরিদর্শকরা মূল দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, দেশে মান যাচাইয়ের প্রতিষ্ঠান সংখ্যা কম। যারা আছে, তারা অধিকাংশই খেলাপির তালিকায়। আমরা যাদের ওপর ভরসা করছি, তারা দুর্নীতি করে বড়লোক হচ্ছে। আমরা চাই বিএসটিআই বা সায়েন্সল্যাবের সঙ্গে বইয়ের মান যাচাইয়ের চুক্তি করতে। গতবছর পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা ইন্ডিপেনডেন্ট নামের কোম্পানিকে জরিমানা করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এবার এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সেন্ট্রাল প্রকিওরম্যান্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) আবেদন করা হয়েছে।

বইয়ের মান নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও শিক্ষকরাও প্রশ্ন তুলেছেন। তারা জানান, এ বছর যে বই দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে এক বছর চালানো সম্ভব নয়। অনেক বইয়ের পাতা খুলে খুলে পড়েছে। অথচ কয়েকবছর আগেও সরকারের দেওয়া বিনামূল্যের বইয়ের ছাপার মান, ছবি ও কাগজ নিয়ে বড় ধরনের কোনো অভিযোগ ছিল না।

এবার বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পেতে প্রাক্কলিত দর থেকেও ৩৫ শতাংশ কম দাম আহ্বান করেছে ছাপাখানা মালিকরা। আবার ছাপা মেশিনের বাড়তি সক্ষমতা দেখিয়ে অধিক পরিমাণ কার্যাদেশ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। ফলে কম টাকায় ছাপানো হবে নিম্ন মানের পাঠ্যবই, অতিরিক্ত কাজ নেওয়ার কারণে সঠিক সময়ে সরবরাহ সম্ভব হবে কী না তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, টেন্ডারে ৮০ গ্রাম ওজনের কাগজের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ ৫০ থেকে ৬০ গ্রাম ওজনের কাগজে বই ছাপানো হয়। বোর্ডের (এনসিটিবি) এই সুযোগ দেওয়ার কারণে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো সেটিই করে চলেছে। গতবার যারা এই মানের কাগজ দিয়েছেন, তারা এ বছরও সুযোগ নেওয়ার জন্য ৩০ থেকে ৩৮ শতাংশ কম দামে দরপত্র দিয়েছেন। ফলে এ বছরও তারা নিম্নমানের বই দেবেন বলে ধরে নেওয়া যায়।

এ বিষয়ে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বইয়ের মান যাচাইয়ে যে বইগুলো দেওয়া হয় তা ভালোমানের। মান উতরে ওসব প্রতিষ্ঠান আবারও নিম্নমানের বই তৈরি করে মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করে। যে কারণে খাতা-কলমে বইয়ের মান ঠিকঠাক থাকলেও বাস্তবে তা দেখা যায় না। ফলে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। এই আইনের প্যাচে অনেক ছাপাখানা মালিকরাই নিম্নমানের বই সরবরাহ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন।

এ বছর প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। অনেক উপজেলায় সেসব বই পৌঁছেও গেছে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে ক্রয় কমিটির অনুমোদনও মিলেছে। এনসিটিবির কাছে অনুমোদনের কাগজ আসার পর এসব বই ছাপানোর কার্যক্রম শুরু হবে। ছাপাখানার কার্যক্রম বর্তমানে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও পুরোদমে বই ছাপার কাজ শুরু হয়ে যাবে চলতি সপ্তাহেই। এ ছাড়া অষ্টম শ্রেণির বইয়ের মূল্যায়ন ও টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। নবম শ্রেণির বই লেখার কাজ শেষ হয়েছে। বইয়ের ডিজাইনের কাজ চলমান। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভুল ত্রুুটি সংশোধন করে পাঠ্যবই চূড়ান্ত করা হবে।

এনসিটিবি সদস্য (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, নবম শ্রেণির বই দেরিতে ছাপাখানায় গেলেও ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা সম্ভব। বর্তমানে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিকসহ মাধ্যমিকের অন্যান্য বই ছাপার কাজ করছে। অক্টোবরে এসব কাজ শেষ করে অষ্টম ও নবম শ্রেণির ছাপার কাজ শুরু হবে। তখন অন্যান্য শ্রেণির বই ছাপার কাজ না থাকায় দ্রুত এসব বই ছাপা সম্ভব হবে। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে বই ছাপার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান জানান, এ বছর নির্বাচনের কারণে প্রাথমিকের সব বই ২০ নভেম্বর এবং মাধ্যমিকের বই ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে। সেই হিসেবে ছাপাখানার মালিকদের ৪৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে, তবে তারা ৬০ দিন সময় চেয়েছেন।

চলতি বছর প্রি-প্রাইমারি থেকে নবম শ্রেণি ও সমমানসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৩৪ কোটি বই ছাপার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এসব বইয়ের জন্য মোট বরাদ্দ আছে ১৫শ’ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে মাধ্যমিকের সাড়ে ২৩ কোটি বইয়ের জন্য বরাদ্দ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। প্রাথমিকের প্রায় ১০ কোটি বইয়ের জন্য বরাদ্দ ৪০৬ কোটি টাকা। এ বছর শিক্ষক সহায়িকা বইয়ের জন্যও বরাদ্দ রাখা হয়েছে।জনকন্ঠ

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১১/০৯/২০২৩     

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়