বিদ্যমান বিভাজিত শিক্ষা, সঙ্কট উত্তরণের উপায় কী

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদঃ বাংলাদেশের সংবিধানের শুরুতেই বলা হয়েছে, “আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।” এই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে বিশ্বে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এজন্য ১৯৭৪ সালে ড. মোহাম্মদ কুদরাত-এ খুদার নেতৃত্বে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় এবং অদ্যাবধি ১১টি শিক্ষা কমিশন/কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রত্যেক কমিশনের লক্ষ্য ছিল কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে শিক্ষাক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। সর্বশেষ ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার লক্ষ্যে উল্লেখ আছে, ‘বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী স্থানিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষা লাভের সমান সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা। শিক্ষাকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করা।’ অর্থাৎ শিক্ষাকে সবার জন্য উন্মুক্ত করা যাতে শিক্ষার্থীরা সহজেই শিক্ষালাভ করতে পারে এবং তাদের দ্বারা একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের শুভ সূচনা হয়। কারণ ‘একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বিকাশমান নাগরিকদের মেধা, মনন, সদিচ্ছা ও আশা-আকাক্সক্ষায় নিয়ত বাস্তব সমস্যার সমাধান ও সমাজ পুনর্গঠনের কাজ চলে। এসবের পরিণত রূপই উন্নত রাষ্ট্র, উন্নত সমাজ। এই বিকাশমান পথটিই শিক্ষার পথ।

বাস্তবের চিত্র সংবিধানের চেতনাকে অতিক্রম করে। কমিশনের নীতিমালাকে উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা ধারার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এর মধ্যে কিছু কিছু সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি, এমপিওভুক্ত, নন এমপিওভুক্ত, স্বায়ত্তশাসিত স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, কৃষিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও কর্তৃক নানা প্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল প্রভৃতি। উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, কিছু উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও কিছু অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। আবার অন্যভাবে বলা যায়, নানা ধারার শিক্ষার মধ্যে সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা অন্যতম। উপরোক্ত ধারার আবার নানা উপধারাও রয়েছে। ফলে বিভিন্নমুখী শিক্ষার কারণে শিক্ষার্থীরা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এ রকম পরিকল্পনাবিহীন নানা ধারার শিক্ষা সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী এবং এই এর কারণ শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হয়। এই অবস্থার ব্যাখ্যায় হাসান আজিজুল হক মনে করেন, “এই শিক্ষাব্যবস্থা শাসকদের, মালিকদের, জনগণের নয়। আমাদের দেশের শিক্ষা এতটাই পশ্চাদমুখী ও অগণতান্ত্রিক যে তা সমাজের বোঝা বাড়িয়ে চলেছে।” উপর্যুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার প্রায়োগিকতা বিচার এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষার সাংবিধানিক নীতিমালার কথা বর্ণিত হয়েছে। যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে সংবিধান রচিত হয় এবং উপরিউক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে বাস্তবে এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় এবং এক ধারার শিক্ষার সাথে অন্য ধারার শিক্ষার ব্যবধান দেখা দেয়।

শিক্ষাদর্শনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভাববাদী ও প্রকৃতিবাদী। তিনি শিক্ষা বলতে শিক্ষার্থীর আত্মোপলব্ধিকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে শিক্ষা হবে প্রকৃতিকেন্দ্রিক। কারণ প্রকৃতি হলো শিক্ষার্থীর উপযুক্ত শিক্ষক। প্রকৃতিতে সে জন্ম নেয়, প্রকৃতির আলো বাতাসে সে বেড়ে ওঠে, প্রকৃতির শিক্ষাই তাকে সমাজের যোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত করে। অর্থাৎ “মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে নাড়ির সম্পর্ক তা যে শিক্ষা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শেখায় না সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নয়। “রবীন্দ্রনাথ এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন যেখানে শিক্ষার্থী শিক্ষাকে নিজ জীবনে গ্রহণ করবে ও কার্যকর করবে এবং শিক্ষার্থী কি শিক্ষাজীবনে কর্মজীবনে প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করবে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। উপর্যুক্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, প্লেটোর দর্শনে শিক্ষার্থীর মধ্যে সত্য, সুন্দর ও পরম কল্যাণের বিকাশে শিক্ষার ভূমিকা রয়েছে, রুশোর চিন্তা প্রকৃতিকেন্দ্রিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠবে এবং সৃজনশীলতার বিকাশ হবে। শিক্ষার্থীর আত্মোপলব্ধির মধ্যে শিক্ষার সার্থকতা নিহিত বলে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন, জন ডিউঈ বাস্তব উপযোগিতাকে মানদণ্ড ধরে শিক্ষার লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেছেন। শিক্ষার্থীর দৈহিক বিকাশের সাথে সাথে মানসিক বিকাশ দরকার এবং এই মানসিক বিকাশের জন্য শিক্ষার ভূমিকা অনন্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশের সাথে সাথে শিক্ষার উপযোগিতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ যে শিক্ষা বাস্তবে কাজে লাগে সেটাই যথার্থ এবং সেই শিক্ষাই বাস্তবায়ন করা উচিত, এটাই প্রয়োগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

শিক্ষাকে সার্থক করার জন্য পাঠ্যক্রম বা পাঠ পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার ঘোষিত নিয়ম অনুসারে বাংলাদেশে একই ধারার সব প্রতিষ্ঠানে (সরকারি-বেসরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত) একই পাঠ্যক্রমে পাঠদান করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সরকারি নিয়ম উপেক্ষা করে অনেক প্রতিষ্ঠানে তাদের নিজস্ব নিয়মে নিজেদের মতো করে অতিরিক্ত পাঠ্যক্রমে পাঠদান করা হয়ে থাকে- যা শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং বিভাজন তৈরি হয়। সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষণ-পদ্ধতি একরকম নয়। শিক্ষার্থীরা এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে গেলে ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা-প্রক্রিয়ায় নিজেকে মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হয়। আবার একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়াও একই রকম হয়। ফলে শিক্ষক থেকে শিক্ষকের শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা দেখা দেয়। এতে জ্ঞানার্জনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তারতম্য লক্ষ্য করা যায় এবং বিভাজন সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার অসমতা/দুর্বলতাই শিক্ষা লাভে বিভাজন সৃষ্টির জন্য দায়ী। শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শিক্ষা উপকরণের ভূমিকা অপরিসীম। অঞ্চলভেদে বা স্থানভেদে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা উপকরণের ক্ষেত্রে ব্যবধান থাকায় শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় বৈষম্য বিরাজ করে। এ ছাড়া শিক্ষার পরিবেশ, সংস্কৃতিগত সঙ্কট, ক্রীড়ামূলক শিক্ষা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগের অসমতা, শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দে বৈষম্য, অবকাঠামোগত তারতম্য, প্রতিষ্ঠানগত বৈষম্য, শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ভাষাগত তারতম্য, বিভাজিত শিক্ষায় শিক্ষকের বেতন বৈষম্য এবং সর্বোপরি বিভাজিত শিক্ষা বিভাজিত গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে থাকে। এহেন ইস্যুসমূহ শিক্ষা বিভাজনের সঙ্কট স্বরূপে শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় দিনের পর দিন এ বৈষম্য আরো প্রকট থেকে প্রকটতর আকার ধারণ করছে।

দেশে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে কিন্তু সুযোগ-সুবিধার ভিন্নতার কারণে তা শিক্ষার মূল লক্ষ্যের অন্তরায়। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক প্রতিবন্ধকতার কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সমভাবে তৈরি করতে পারছে না। এতে শিক্ষার লক্ষ্য শুধু ব্যাহত হচ্ছে না বরং শিক্ষার্থীর সুন্দর জীবন গঠন, সদ্ভাবে জীবনযাপন, সৎ চরিত্রের অধিকারী হওয়া তথা সুনাগরিক হয়ে বেড়ে ওঠার স্বপ্ন কল্পনায় থেকে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধারার শিক্ষার কারণে একজনের ভাবনা থেকে অন্যজনের ভাবনায় পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই পার্থক্যের কারণে শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা দেখা দেয় এবং এই ভিন্নতার কারণে শিক্ষার্থীরা যেটুকু গ্রহণ করতে পারছে তা দিয়ে সমদক্ষতার জনশক্তি তৈরি সম্ভবপর হচ্ছে না। ফলে এই শিক্ষার দ্বারা সমাজ তথা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। শিক্ষার প্রায় সকল স্তরে একই অবস্থা। সারা পৃথিবীতে সাংস্কৃতিক শিক্ষার সঙ্কটের কারণে জাতিগত ভেদাভেদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়। এর কারণ মানুষের শিক্ষায় সংস্কৃতিগত জ্ঞানের দুর্বলতা। বাংলাদেশে নানা ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাংস্কৃতিক চর্চার ভিন্নতা শিক্ষার্থীদের আরো পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীর নৈতিক ও মানবীয় গুণাবলীর বিকাশে তারতম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নানাক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকায় জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সমান সুযোগ পাচ্ছে না। এই অবস্থা শহর ছেড়ে আজকাল গ্রামাঞ্চলেও বিস্তার লাভ করেছে। এমনকি প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের শিক্ষা পর্যন্ত এই কোচিং ব্যবসার বিস্তার ঘটেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা সীমিত জ্ঞান অর্জন করে, নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে সংক্ষিপ্ত ও সহজ উপায়ে আপাত ভালো রেজাল্ট বা গ্রেড লাভ করছে। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের বৈষম্য, প্রতিযোগিতায় বিভাজন, সামাজিকীকরণ ব্যাহত, সামাজিক পরিবর্তন বাধাগ্রস্ত, ধনী-দরিদ্রের হার বৃদ্ধি, সঙ্গতি বিধান বাধাগ্রস্ত, মেধাবিহীন সমাজব্যবস্থা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হয়ে শিক্ষায় এক নেতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। শিক্ষা বিভাজনের ফল হিসেবে উল্লেখিত নেতিবাচক ইস্যুগুলো বৈষম্যের মাত্রাকে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছে।

আমাদের দেশের বিভাজিত শিক্ষা গুণগত শিক্ষার অন্তরায়। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গগত বিভাজন শিক্ষার লক্ষ্যের শর্ত পূরণ করে না এবং পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ভিন্নতা রয়েছে। আবার বেতন কাঠামোর বৈষম্য শিক্ষার বিভাজনকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের স্বল্পতা ও শিক্ষণ-পদ্ধতির ভিন্নতার কারণে শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় পার্থক্য দেখা যায়। এজন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাকে সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে এবং বলতে হবে। ‘শিক্ষা শুধু মানবাধিকার নয়, এটি সামাজিক খাতের অন্যতম ক্ষেত্র যার রিটার্ন অথবা ফল হাতে হাতে পাওয়া না গেলেও শিক্ষা যে মানুষের এবং সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রধান অনুঘটক, তা আজকের দুনিয়ায় সর্বজনমান্য। কাজেই “জোরজবরদস্তি করে শিক্ষাদান নয়, শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তুলতে হবে। আমাদের জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে তুলতে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃত শিক্ষা, জ্ঞান, প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

এই অবস্থায় শিক্ষার কাঠামোকে পরিবর্তন অথবা সমন্বয় করতে না পারলে জাতি মেধা ও নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে। তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ অতীব জরুরি। বিশেষ করে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর ও জীবনের জন্য প্রায়োগিক শিক্ষা দরকার। তবে যে শিক্ষা শুধু প্রায়োগিক প্রয়োজন বা উপযোগিতাকে মানদণ্ড বিবেচনা করে তা একটি সমাজ বা রাষ্ট্রকে সামগ্রিক কল্যাণের দিকে এককভাবে নিয়ে যেতে পারে না। প্রয়োজনমুখী বা বাস্তবতাকেন্দ্রিক শিক্ষার সাথে সাথে শিক্ষার্থীর মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, স্নেহ, ভালোবাসা, মমত্ববোধ, সমতা, ন্যায়পরতা প্রভৃতি মানবিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। উপর্যুক্ত পর্যালোচনায় এটা প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের বিদ্যমান বিভাজিত শিক্ষার ফলে নানা সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। একই সাথে বসবাস করে কেউ অর্থের জোরে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে। আর কেউ নানাভাবে অবহেলিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করছে। এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে অর্থ থাকলেই একজন তার পছন্দমতো বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পায়। এর ফলে মানসিক দিক থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিস্তার ফারাক। এই বিভাজিত শিক্ষা সংবিধানের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। শিক্ষা সংবিধানে যেভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে, তাতে সেখানে সকলের সমান সুযোগ লাভের কথা বলা হয়েছে।

কুদরাত-এ-খুদার প্রথম শিক্ষা কমিশনে সংবিধানের নির্দেশিত পথে শিক্ষাকে সমন্বিত করার কথা বলা হলেও নানা কারণে তার বাস্তবায়ন হয়নি।

বিভিন্ন ধারার শিক্ষার সমন্বয় না থাকায় দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ তৈরি করা যাচ্ছে না। ফলে কর্মজীবনে সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবার বিভিন্ন ধারার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিকতা ভিন্নভাবে গড়ে ওঠে যা সামাজিক সহিষ্ণুতা রক্ষার অন্তরায়। তাই এই শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানে যে নীতির আলোকে মানুষের শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণকে বিবেচনায় না নিয়ে সকলের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে, বিভাজিত শিক্ষায় তা উপেক্ষা করা হচ্ছে। এজন্য সমাজেও অসমতা সৃষ্টি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বৈষম্য এবং এই বৈষম্য ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। প্রায়োগিক দিক থেকে বিচার করলে আমাদের দেশের বিদ্যমান বিভাজিত শিক্ষা জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। একই দেশে একই সাথে বসবাস করেও সুবিধা প্রাপ্তিতে পার্থক্য দৃশ্যমান। সুতরাং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আশু সঙ্কট সমাধানের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে সংস্কার ও পরিবর্তনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক এবং সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/১০/২০২৩   

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়