অনেক দিন আগে শ্রাবনের অজানা কোন রাতে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিলাম বেড়াতে। বাঙ্গালির চিরাচরিত রীতি অনুসারে কারও বাসায় মেহমান হলে সঙ্গে কিছু নিয়ে যেতে হয়- তাই খানিকটা আপেল নিয়েছিলাম। বাসায় ঢুকে আপেলের পোঁটলাটা মেজবানের হাতে দিলেও উনার নাখোশ আননটি বুঝতে পেরেছিলাম রাতের খাবারের পর- যখন আমার সামনে প্লেট ভর্তি আপেলের ফালি ফালি টুকরা পরিবেশন করা হয়েছিল।
একটা টুকরা হতে নিয়ে উনাদেরকে নিতে বললে জবাব এলো, আমাদের কেউ আপেল খায় না। অজানা অপরাধবোধের লজ্জায় বিস্মিত হলাম! পর দিন সকালেও সেই একই কান্ড ঘটল এবং মজার বিষয় হলো- যে দুদিন ওখানে ছিলাম, ঐ সময়ের মধ্যে পুরোটাই শেষ করে আসতে হয়েছিল আমাকে।
বেশ কিছু দিন পর আমার এক বন্ধু এই অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাতে গিয়ে পড়েছিল মহাবিপাকে। সে তার কোন আত্মীয়ের বাসায় এক কেজি মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিল; সোজা সাপটা মুখের উপর বলে দিল মিষ্টি কেন এনেছো? জানো না সবার ডায়াবেটিস, আমরা তো কেউ মিস্টি-টিস্টি খাইনা! মনের বিরক্তিটা দাঁত চেপে মৃদু হেসে হালকা সুরে ‘ও’ বলেছিল তাতে কি হয়েছে- কাজের লোক আছে না! ঘটনাদুটি যেন কুমির ও শিয়ালের জমি চাষে ভাগাভাগির বন্দোবস্ত করার মতোই বৈকি!
শহরের মানুষের গ্রামের সজিব ও মনোরম জিনিসের উপর একটা দূর্বলতা থাকাটাই স্বাভাবিক। সে ভাবনা থেকেই আমার এক পরিচিতজন ঢাকা যাবার প্রাক্কালে অনেক কষ্ট করে বেশ কিছু দেশি মুরগি নিয়ে গিয়েছিল এক বাসায়; গৃহকর্তা অতিশয় ভদ্রলোক বিধায় তাকে বিব্রত হতে হয়নি। শুধু এতটুকু বুঝেছিল গতকালই উনি এগুলো কিনেছেন। নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু হেসে সে বলেছিল দেশি না সোনালি!
গিন্নীর অনুরোধে তার অনেক কষ্টের নিজ হাতে তৈরি দ্রব্যাদি কোন প্রিয়জনকে দিতে গিয়েও অনেকেই হয়ত এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন বহুবার! পোশাকের কথা আর নাই বা বললাম! যত দামি আর সুন্দরই হোক না কেন সবই ফুটপাত আর ফুটপাত! এভাবে একটি নয়, বলতে থাকলে একের পর এক আসতেই থাকবে।
বাঙ্গালি মনের স্বরূপ উন্মোচন করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়; যা অনেক আগেই স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়, আহমদ ছফা, ডাঃ লুৎফর রহমান ও মুহাম্মদ আবদুল্লাহ খানের মতো মনীষীরা বুঝিয়েছেন তাঁদের ধারালো লেখনীতে।
বিশেষ করে প্রযুক্তির প্রাদুর্ভাবে মানুষের সম্পর্কগুলো আজ ঘুণ ধরতে শুরু করেছে; আচার-আচরণ ও ভালোবাসাগুলো যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবটে পরিণত হতে শুরু করেছে; সামাজিক বন্ধনগুলো শিথিল হয়ে পড়ছে; একই ছাদের নিচে বছরের পর বছর বসবাস করেও নিজেদের মধ্যে দেখা বা কথা হওয়ার সুযোগটা সংকুচিত হয়ে আসছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন কেবলই লাভ-ক্ষতি আর সুদকষার গাণিতিক হিসেব কষতে শিখছে! আমি বরং সেই পথে না যেয়ে মানানসই একটি গল্প দিয়েই এ লেখার সমাপ্তি টানি।
খলিফা হারুনুর রশিদের আমলে এক সময় বাগদাদে বিশুদ্ধ পানির বেশ অভাব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু খবরটি প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে পানির সেই দৈন্য দশার অবসান ঘটেছিল। এর বেশ কিছু দিন পর রাজদরবার থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো: কোন প্রজা যদি নতুন এবং বিষ্ময়কর কিছু বাদশাকে উপহার দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে, তাহলে তাকে যথোপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে।
প্রত্যন্ত গ্রামের এক কৃষক পরিবার এই সংবাদটি শুনে বাদশাকে কি উপহার দেওয়া যায় তাই নিয়ে ভাবতে লাগল। অনেক ভেবে হঠাৎ তাদের নজর পড়ল ঘরের কনে রাখা পানির কলসির উপর, উহাতে বৃষ্টির পানি জমা করে রাখা ছিল। খুশিতে তারা বলতে লাগল- নিশ্চয়ই খলিফা ইহাতে খুশি না হয়ে থাকতেই পারবেন না!
ভাবনা মতে- লোকটি খুব সকালে পানির ঠিলার মুখ ভালোভাবে বেঁধে নিয়ে রওনা হলো বাগদাদের উদ্দেশ্যে। তখনকার দিনে গাড়ি-ঘোড়া তেমন ছিল না, তাই পায়ে হেঁটে বাগদাদে পৌঁছতে অনেক দিন পার হয়ে গেল। অবশেষে বাদশার দরবারে হাজির হয়ে তার উপহার পেশ করল।
কলসির মুখ খুলতেই উৎকট গন্ধে চারিদিক মলিন হয়ে উঠল; সবাই তো হতবাক! কিন্তু বাদশা লোকটিকে অনেক বেশি উপঢৌকন দিয়ে বিদায় দিলেন এবং প্রহরীকে বললেন উনাকে যাবার পথে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর পাশের রাস্তাটা দেখিয়ে দিও। ফেরার পথে লোকটি ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর নির্মল ও পরিশুদ্ধ পানি দেখে খুব লজ্জা পেল এবং মনে মনে ভাবতে লাগল বাদশা তো- ‘আমাকে উপঢৌকন না দিয়ে শাস্তিও দিতে পারতেন’, কিন্তু তা করলেন না কেন?
এই প্রশ্নের প্রকৃত সমীকরণটি বাঙ্গালি মানুষের মন মিলাতে পারবে কি কখনও! পারবে কী এর মমত্ব ছুঁয়ে মাহাত্ম্যের আলিঙ্গনে হৃদয়কে ¯িœদ্ধ ও সজিবতায় পরিতৃপ্ত করতে? হয়ত অনেক জবাবের মাঝে একটি-ই বার বার ফিরে আসবে, আর তা হলো- “আমরা অনেক সময়ই ভুলে যায় আমরাও মানুষ”! মনুষত্বের চেয়ে মানুষের আর কোন পরিচয়-ই অর্থবহ ও টেকসই হয় না।।
লেখক: ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত (শিক্ষা কর্মী)