“এক সুরাহি সুরা দিও একটু রুটির চিলকে আর
প্রিয়া সাকী, তার সাথে একখানি বই কবিতার।
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ
এই যদি পাই চাইবো নাকো তখত আমি শাহেনশাহর”।
পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম রুটি, সুরা ও প্রিয়ার সাথে একটি বইও চেয়েছেন। এসব পেলে তিনি আর শাহেনশাহ (প্রধানমন্ত্রী) হতেও চান না। বইয়ের গুরুত্ব তিনি দ্বাদশ শতাব্দীতে বুঝতে পেরেছিলেন। বই এমন একটি আত্মার উপকরণ যা একজন মানুষকে বিনয়ী, সভ্য জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে প্রকৃত অর্থে মানুষে রূপান্তর করে। একুশ শতকে প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী প্রভাবে পৃথিবী বদলে গেলেও মলাটে বাঁধা একখানা বই এখনো আমাদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। এখনো তার প্রভাবে প্রভাবিত হয় ব্যক্তি, সমাজ, নগর ও রাষ্ট্র।
পৃথিবীর সবচে উন্নত সভ্যতার অন্তরালে তাকালে দেখা যায়, তাদের এসবের পেছনে রয়েছে সুস্থ জ্ঞানচর্চা। জ্ঞানচর্চার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বই । বই একটা শব্দ, একটা অনুভূতি। বইয়ের স্পর্শ পাই আমরা ছোট্ট বেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
নতুন বইয়ের অত্যন্ত উপভোগ্য ঘ্রাণ না নিয়ে যাদের শৈশব কেটেছে তারা নিতান্তই হতভাগা। এরপর বেড়ে উঠার সাথে সাথে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বইয়ের যে বিশাল জগৎ আছে তা আমরা অনুমান করতে পারি। লোকমুখে প্রচলিত আছে বই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। যে বইকে আপন করে নিতে পেরেছে জগৎ তাকে আপন করে নিয়েছে। এজন্য ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, রাজ্য জয় করে রাজারা সমস্ত জিনিস ধ্বংস করলেও বই বা লাইব্রেরি নষ্ট করেনি। কারণ তারা এই সম্পদের কদর জানতো ।
একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রায় অর্ধশতক বছর পার করে দিলেও জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা বিস্তার ও গবেষণার মত বিষয়গুলোতে তুলনামূলক আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অথচ আমাদের পরে স্বাধীনতা লাভ করে অনেক দেশ আজ বিশ্ব সেরার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। সে বিশ্লেষণ বিভিন্ন দিক থেকে করা যায়, তবে আমি জ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব।
প্রথমত প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে বলতে চাই । প্রাথমিক স্তরে সরকারি বই কম থাকলেও বেসরকারি স্কুল গুলোতে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে শিশুদের উপরে। এতে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমন অভিযোগও আছে, শিশুদের ওজনের চেয়ে বইখাতার ওজন বেশি হয়ে যাচ্ছে ।
সরকারি নিয়ন্ত্রণ তেমন কার্যকর না থাকায় অধিক মুনাফার আশায় খুব ভোরে স্কুলগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম চালানো হয়, এতে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে ধর্মীয় শিক্ষার, শিশু স্বাস্থ্যের এমনকি অভিভাবকের পর্যন্ত। একদিকে অতিরিক্ত বইয়ের চাপাচাপি অন্যদিকে সময়ের সমন্বয়হীনতা কোমলপ্রাণ শিশুদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করছে। শেষে এমন হয়েছে বই তাদের কাছে এক বিভীষিকার নাম এবং বিরক্তির উপকরণ।
সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার ফলশ্রুতিতে ছাত্রছাত্রীদের রাগ ক্ষোভ পড়ছে বইয়ের উপর। ফলে বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদির প্রতি আসক্তি জেগে উঠছে। মাধ্যমিক স্তরে সরকারি নীতিমালা অনুসারে প্রচুর পাঠ্যবই সংযোগ করা হয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, নবম শ্রেণির বাংলা বিষয়ের জন্য রয়েছে চার চারটি বই। যথা- সাহিত্যকণিকা, সহপাঠ, বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা নির্মিতি। অথচ এতোগুলা বইয়ের প্রয়োজন নেই। সংখ্যাটা বেশি হলেও প্রয়োজন যৎসামান্য। অন্যান্য বিষয় নিয়ে গড়ে ১৩/১৪টি বই শিক্ষার্থীদের গিলতে হচ্ছে প্রতিবছর । মাধ্যমিকের এই সময় তাদের মানসিক বিকাশে বই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্প, উপন্যাস, কবিতা পড়া ও লেখালেখির অভ্যাস গড়ার এই সময়ে শিক্ষার্থীরা বই থেকে বিচ্ছিন্ন। তার মূল কারণ এতোগুলা বই ডিঙিয়ে নতুন করে বই পড়ার অভ্যাস তারা করতে পারছেনা। তারা ভাবছে পাঠ্যের বাইরের বইগুলো তার পরীক্ষার খাতা কিংবা জিপিএ-তে কোনো ভূমিকা রাখবে না। এভাবেই একটা প্রজন্ম ক্রমান্বয়ে বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
জ্ঞানচর্চার দ্বারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ দিচ্ছি। চট্টগ্রাম শহরে যতগুলা রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, পার্কসহ অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্র আছে তার পাঁচ শতাংশও লাইব্রেরি নাই। যা কিছু আছে তার বেশিরভাগই পাঠ্যের সাপ্লিমেন্ট ও গাইডের আড়ত মাত্র। সাহিত্যে জগতে বিচরণের লাইব্রেরির প্রদীপ আজ নিবু নিবু । এভাবে চলতে থাকলে এই জাতির কাছে নজরুল, জীবনানন্দ, হুমায়ুন আহমেদ, আহমদ ছফা’র মত লেখকরা আসবে না। বোধ ও মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হওয়ার মহাসড়কে পৌঁছে গেছি আমরা।
একটি মেধাশূন্য জাতিকে সহজে পরাস্ত করতে পারবে যেকেউ। মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানিরা বুঝে গিয়েছিল তাদের পরাজয় নিশ্চিত, তাই তারা বেছে বেছে এদেশের লেখক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তারা চেয়েছিল আমরা যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি এবং হয়েছেও তাই। এক পা এগোয় তো দু পা পিছিয়ে পড়ি। সুতরাং আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনে বইয়ের সংস্পর্শে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, একটি কলেজে সেমিনার নেয়ার সময় প্রশ্ন করেছিলাম পাঠ্যের বাইরে বই পড়ে কতজন? উত্তরে তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে হাত উঠেছে মাত্র ৬ জনের । শতকরা হিসেবে মাত্র ২ ভাগেরও কম। এই পরিসংখ্যান আমাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। একজন মানুষের স্বাভাবিক বেড়ে উঠার জন্য সবধরনের পুষ্টি উপাদান সম্পন্ন খাবার খেতে হয় । ঠিক পরিপূর্ণ আত্মাবান মানুষ হতে হলে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ বই পড়ার। কারণ আত্মার খাদ্য হচ্ছে বই।
সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা কমিয়ে গুণগত মান বাড়ানো। নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা চলছে। আশাকরি সেখানে এর সুফল দেখতে পাবো । প্রতিটা স্কুল কলেজে নামমাত্র পড়ে থাকা লাইব্রেরিগুলাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিটা পাড়ায়, গ্রামে, ইউনিয়নে লাইব্রেরি স্থাপন করতে হবে। সেখানে উন্মুক্ত পাঠচক্র আয়োজন করতে হবে এবং সকল বয়স পেশার মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রতিটি উপজেলা ও সিটিতে অনেকগুলো ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড রয়েছে।
প্রতিটি ইউনিটে চেয়ারম্যান, মেয়ররা চাইলে তাদের অফিস গুলোর অব্যবহৃত কক্ষগুলোতে খুব সহজে একটি করে লাইব্রেরি স্থাপন করতে পারেন। এতে জনপ্রতিনিধিদের সাথে সাধারণ মানুষের সখ্যতা গড়ে উঠবে। কিন্তু এতো সুন্দর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সোনার মানুষ থাকা চাই। গড়পড়তা বাঙালির মত আমি নই, আশা আমি রাখতেই পারি।
প্রতিটা উপজেলায় অন্তত একটি সমৃদ্ধ পাবলিক লাইবেরি থাকা চাই । আমি যদি অতিরিক্ত ফ্যান্টাসিতে না পড়ে থাকি, তবে বলা যেতে পারে প্রতিটি শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান লোকের বাড়িতে একটা লাইব্রেরি থাকাটা স্বাভাবিক বরং না থাকাটায় ব্যতিক্রম।
সর্বত্র এমন পরিবেশ থাকলে একটা প্রজন্ম বই প্রেমিক হয় উঠবে, তখন তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে আকাশচুম্বী। প্রাপ্তিটা তখন মিলিয়ে নিতে হবে।
মানুষের হৃদয়ে জ্ঞানের আলো জ্বালানো এক কঠিন ব্রত । অধ্যাপক আব্দুলাহ আবু সাঈদ স্যার ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করে আলোকিত মানুষ খুঁজছেন বহুবছর ধরে। কিন্তু তিনি একা কতদূর পারবেন, প্রতিটা ‘আমি’কে এই ব্রত গ্রহণ করতে হবে।
আপনি যদি সময়ের সেরা মানুষটা হয়ে থাকেন তবে আপনি বই কিনবেন, বই উপহার দিবেন, বই পড়বেন। আসুন জ্ঞানের আলোয় সাজাই সুন্দর পৃথিবী। শেষ করছি টলস্টয়’র মন্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছেন. “জীবনে তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ন। যথা: বই, বই এবং বই” ।
লেখক: চেয়ারম্যান, আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নয়া দালান