নিউজ ডেস্ক।।
দেশের প্রাথমিক স্তরের ৭৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ৮২.৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই তাদের পাঠ ও পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বাণিজ্যিক গাইড বই অনুসরণ করে। এ জন্য ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি শিক্ষার্থী গড়ে ৬৬৯ টাকা এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ২ হাজার ৬৫ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে।
একই সময়ে অষ্টম শ্রেণির ৯০.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং নবম শ্রেণির ৯২.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটর বা কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। শহর ও গ্রামাঞ্চল সব পর্যায়েই এই চিত্র দেখা গেছে। অভিভাবকদের তথ্য অনুযায়ী, অষ্টম শ্রেণির প্রায় ৬৪ শতাংশ এবং নবম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরিংয়ের জন্য প্রতি মাসে এক হাজার টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। এই গবেষণা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ‘মহামারী-উত্তর শিক্ষা : স্কুলশিক্ষার পুনরুদ্ধার ও আগামীর অভিযাত্রা’ শীর্ষক এডুকেশন ওয়াচ ২০২২ নামের এ প্রতিবেদন গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এডুকেশন ওয়াচের সভাপতি ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, শিক্ষকনেতা কাজী ফারুক আহমেদ প্রমুখ। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক ও এডুকেশন ওয়াচের ফোকাল
পয়েন্ট ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
গবেষণায় শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য একটি পরীক্ষা নেওয়া হয় গত অক্টোবর মাসে। এতে দেখা যায়, অষ্টম শ্রেণির ২৮.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ৩৩ শতাংশ নম্বর অর্জন করতে পারেনি। নবম শ্রেণির ক্ষেত্রে এটি ছিল ২৬.২ শতাংশ। ডি গ্রেড (৩৩ থেকে ৩৯) অর্জন করেছেন অষ্টম শ্রেণিতে ৩৬.১ শতাংশ এবং নবম শ্রেণিতে ৩৩.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।
বিষয়ভিত্তিক ফলে দেখা গেছে, অষ্টম শ্রেণির ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়, ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে এবং ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ৩৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাস করেছে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলায় ৮৪ শতাংশ, ইংরেজিতে ৭২ শতাংশ এবং গণিতে ৬৫ শতাংশ পাস করেছে। মূল্যায়নে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা তুলনামূলকভাবে ভালো ফল করেছে। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭৪ শতাংশ মেয়ে এবং ৬৮ শতাংশ ছেলে উত্তীর্ণ হয়েছে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ মেয়ে এবং মধ্যে ৭৩ শতাংশ ছেলে উত্তীর্ণ হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ অভিভাবক শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনের অত্যধিক ব্যবহারকে একটি আসক্তি হিসেবে দেখেছেন। কৌতূহলের বিষয় হলো, তিন-চতুর্থাংশ বাবা-মা এটিকে কোনো উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসেবে দেখেননি। প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ যাই হোক, শেখার জন্য প্রযুক্তির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ডিজিটাল যোগাযোগের জন্য ডিভাইসের অনৈতিক ব্যবহার ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।
গবেষণায় অংশ নেওয়া ৯২.৩ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন, ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন ১ থেকে ২ ঘণ্টা মোবাইলে গেমস খেলে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা। মাধ্যমিকের অভিভাবকদের ৮১.১ শতাংশ জানান, তাদের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন ১ থেকে ২ ঘণ্টা মোবাইলে গেমস খেলে ব্যয় করে। গবেষণায় ভৌগোলিক এবং উন্নয়ন বৈচিত্র্য ও বিস্তার বিবেচনায় আট বিভাগের আট জেলা এবং ২১ উপজেলা, দুটি সিটি করপোরেশনকে অন্তর্ভুক্ত করে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বড় সমস্যা হিসেবে ‘শিখন না, পাস চায় সবাই’- উল্লেখ করে এডুকেশন ওয়াচের সভাপতি ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, শিক্ষার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থাপক, শিক্ষক ও অভিভাবক সবাই শিখন নয়, পরীক্ষায় পাস করাকে ভালো মনে করেন। আমাদের সবার মধ্যে এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, শিখন বলতে বোঝায়- বুঝে পড়া, চিন্তা করা এবং প্রশ্ন করার সামর্থ্য থাকা। এটা আমাদের দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোথাও নেই।
নোট-গাইড প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে খলীকুজ্জমান বলেন, নোট-গাইড ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনেক শিক্ষকের মধ্যে এই প্রবণতা আছে যে তারা নোটবুক লেখায় ব্যস্ত থাকেন। এরা অনেক প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। এ খাতে তাদের বড় আয় হয়।
কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, আমাদের শিক্ষার আরও একটি দিক হলো প্রয়োজনীয় মনিটরিং নেই বা দুর্বল মনিটরিং। বাংলাদেশে নীতি ও আইনের সংকট নেই। অনেক নীতি আছে। কিন্তু সংকট হলো এর বাস্তবায়ন। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বাস্তবায়নের কথা বলে থাকেন; কিন্তু সময়মতো কাজ করেন না। সুযোগ থাকলে নিজেদের পকেট ভারী করেন। এগুলো থেকে বেরোতে হবে। সে জন্য আমাদের সামাজিক পরিবর্তন দরকার।