প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: দুর্বিষহ গণরুম
# ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি হলের আসন সংখ্যা # ১০২টি গণরুমে দুই হাজার শিক্ষার্থীর মানবেতর জীবনযাপন
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা নেই। গত ২৩ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ হাজার ৯৮ জন শিক্ষার্থী বাড়লেও হলগুলোতে আসন সংখ্যা বেড়েছে মাত্র পাঁচ হাজার ৬৯৬টি। আবাসন সংকট প্রকট হওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে দুর্বিষহ গণরুম ব্যবস্থার। হলগুলোর ১০২টি গণরুমে মানবেতর জীবনযাপন করছে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী।
ঢাবিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলার কারণ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘টিউটোরিয়াল পদ্ধতিতে পাঠদান, শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে থেকে লেখাপড়া করবে এসব বৈশষ্ট্যি অক্সফোর্ডের আদলে থাকায় ঢাবিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো।’
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো অক্সফোর্ডের মডেলে এটি তৈরি হয়েছিল বলে। পাঠদান পদ্ধতি, সব শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা, ডিনদের কার্যক্রম ও ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় অক্সফোর্ড মডেলে ছিল বলে ঢাবিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। ঢাবির পাশাপাশি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়কেও এই নামে ডাকা হতো।
দিন দিন সংকট বেড়েছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি শিক্ষাবর্ষ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বার্ষিক বিবরণী বের করে। সেই বিবরণী থেকে পাওয়া যায়, ১৯৭০-৭১ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে মোট সাত হাজার ৪০৭ জন শিক্ষার্থী ছিল। সেসময় আটটি হলে মোট শিক্ষার্থীর ৪৬ শতাংশ আবাসিক হিসেবে থাকত। ১৯৮০-৮১ শিক্ষাবর্ষে ৩৬টি বিভাগ ও সাতটি ইনস্টিটিউটের মোট ১৫ হাজার ৫৫৮ শিক্ষার্থীর ৪৩ শতাংশ ১২টি হলে আবাসিক হিসেবে ছিল।
১৯৯০-৯১-তে ৩৭টি বিভাগ ও সাতটি ইনস্টিটিউটের মোট ২৪ হাজার ২৭৯ শিক্ষার্থীর ৩৮ শতাংশ ১৫টি হলে আবাসিক হিসেবে ছিল। ২০০০-২০০১ শিক্ষাবর্ষে ৪৭টি বিভাগ ও নয়টি ইনস্টিটিউটের মোট ২৫ হাজার ৭৯৭ শিক্ষার্থীর ৫০ শতাংশ আবাসিক হিসেবে ছিল ১৬টি হল ও হোস্টেলে। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ৬৭টি বিভাগ ও নয়টি ইনস্টিটিউটের মোট ৩৩ হাজার ৬৫৮ শিক্ষার্থীর ৫৭ শতাংশ ১৮টি হল ও হোস্টেলে আবাসিক হিসেবে ছিল। সর্বশেষ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৮৩টি বিভাগ ও ১২টি ইনস্টিটিউটের মোট ৪৪ হাজার ৮৯৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৫ হাজার ২০৩ জন বা ৫৬ শতাংশ ২৩টি হল ও হোস্টেলে আবাসিক হিসেবে আছে।
আবাসন সমস্যার কারণ
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিনিয়ত বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়ালেও এর বিপরীতে হল ও হোস্টেল তৈরি করেনি।
২০০০-০১ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ ৪৭টি ও নয়টি ইনস্টিটিউটে ২৫ হাজার ৭৯৭ শিক্ষার্থী ছিল। হল প্রশাসনের সূত্রমতে, সে সময় ১৬টি হল ও হোস্টেলে আসন সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৩৬৭টি। আর ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৮৩ বিভাগ ও ১২ ইনস্টিটিউটে ৪৪ হাজার ৮৯৫ শিক্ষার্থী আছে। বর্তমানে ২৩টি হল ও হোস্টেলে আসন সংখ্যা আছে ১৬ হাজার ৫৩। অর্থাৎ গত ২৩ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ হাজার ৯৮ শিক্ষার্থী বাড়লেও আসন সংখ্যা বাড়ে মাত্র পাঁচ হাজার ৬৯৬টি। এতে আবাসন সংকট আরো প্রকট হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সুবিধা নেই ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
আবাসন সংকট প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সময় প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে চার সিটের রুম, তৃতীয় বর্ষ থেকে অনেক সময় সিঙ্গেল রুমও পাওয়া যেত। এত সমস্যা ছিল না। কারণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম ছিল। আবাসন সমস্যা বেশি হওয়ার কারণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ঢাকা শহরে তাদের থাকার জায়গাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যা বিচার করেই নতুন বিভাগ ও ইনস্টিটিউট তৈরির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রশাসন সেটা বিবেচনায় আনেনি।’
দুর্বিষহ গণরুম
হলগুলোতে সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, হলে আসন না থাকায় নবীন শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে গণরুমে থাকতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৯টি হল ও চারটি হোস্টেল আছে। স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হল ছাড়া ১৮টিতে দেশীয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা থাকে। এর মধ্যে ১৬টি হলে গণরুম দেখা গেছে। এসব হলের অন্তত ১০২টি গণরুমে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী থাকছে। এর মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ছয়টি, স্যার এ এফ রহমান হলে সাতটি, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে পাঁচটি, বিজয় একাত্তর হলে একটি বড়, কবি জসীম উদদীন হলে আটটি, মাস্টারদা সূর্যসেন হলে ১৮টি, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে নয়টি, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে পাঁচটি, জগন্নাথ হলে সন্তোষচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভবনে পাঁচটি, অমর একুশে হলে তিনটি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ছয়টি, ফজলুল হক মুসলিম হলে পাঁচটি, শামসুন নাহার হলে ১০টি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে পাঁচটি, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে চারটি ও কবি সুফিয়া কামাল হলে পাঁচটি গণরুম রয়েছে।
এর বাইরেও বিভিন্ন হলে যারা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত তাদের জন্য বিশেষ করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্ররা ‘পলিটিক্যাল রুমে’ থাকে। যেখানেও এক কক্ষে অনেক শিক্ষার্থী অবস্থান করে। গণরুমে একসঙ্গে একাধিক শিক্ষার্থীকে ছারপোকার কামড় খেয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হচ্ছে। রয়েছে শৌচাগারের সমস্যা। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় পড়াশোনার জন্য কোনো জায়গা ও পরিবেশ না পাওয়া।
গণরুমের পরিবেশ প্রসঙ্গে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শিমুল হুদা বলেন, ‘গণরুমের পরিবেশ একদম বাজে। যার ফলে এক একজনের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ওয়াশরুমের পরিবেশ আরো বাজে। বাধ্য হয়ে অনেক পুরাতন নোংরা ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয়।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফুয়াদ হাসান বলেন, ‘অনেক সংগ্রাম করে হলে থাকতে হয়। প্রথম বর্ষে থাকতে হয় গণরুমে। অনেক গাদাগাদি হয়। রুমে ছাড়পোকা জন্মে। গণরুমে ছারপোকার কামড় খায়নি এমন শিক্ষার্থী খুব কম আছে।’
বানাতে হবে নতুন হল
আবাসন সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন হলগুলো ভেঙে নতুন হল নির্মাণ করতে বলেছেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য অবশ্যই সিটের ব্যবস্থা ও হলগুলোকে ছাত্র রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা ও ভালো পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলেই অক্সফোর্ডের মডেলে আমরা আবারও ফিরে যেতে পারব।’
প্রশাসনের বক্তব্য
হলে শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন প্রাধ্যক্ষরা। তাঁরা বলছেন, সীমিত এ আবাসন নিয়ে যেভাবে পারা যায় তাতে শিক্ষার্থীদের রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। পাশাপাশি নতুন আবাসিক হল ও হলের নতুন ভবন নির্মাণ করার কথাও বলেন তাঁরা।
কবি জসীম উদদীন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. শাহীন খান বলেন, ‘গণরুমের শিক্ষার্থীদের আমরা আলাদাভাবে দেখি যাতে করে তাদের একটু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়। যখনি কোথাও একটি সিট খালি হয়, তখনি আমরা একজন ছাত্রকে সেখানে আসন দিয়ে থাকি। আমাদের সীমিত আসন সংখ্যার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীদের কতটুকু ভালো রাখা যায় সেই চেষ্টা সবসময় করি৷’
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. জাবেদ হোসেন বলেন, ‘প্রথম বর্ষে যারা হলে আসে তারা অনেকটা ধাক্কা খায় এই অবস্থা দেখে। অনেকে হয়তো বাবা- মায়ের কাছে অনেক আদরে থাকত, অনেক ভালো পরিবেশে ছিল। কিন্তু এখানে এসে একটু কষ্ট করে। সেটা আমরা উপলব্ধি করি। এই সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সিট সংখ্যা বাড়াতে হবে। এজন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘হলে আমাদের আসন সংখ্যা কম, শিক্ষার্থীদের আবাসন চাহিদা অনেক বেশি। ফলে গণরুম আমাদের বাস্তবতা। শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট করে সেখানে থাকতে হয়। যখন আরো নতুন ভবন হবে, হল নির্মাণ হবে তখন এই সমস্যার সমাধান হবে।’ সূত্র; কালের কন্ঠ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০১/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়