প্রধান শিক্ষক ফিরোজের বিরুদ্ধে সহকর্মী তিন শিক্ষিকাকে হেনস্তার অভিযোগ!

হাজী লাল মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক, নোয়াখালীঃ  জেলার সুবর্ণচর উপজেলার হাজী লাল মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফিরোজ আহাম্মদের বিরুদ্ধে নারী সহকর্মীদের সাথে অশোভন আচরণ, হিজাব পরা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য, শিক্ষিকাদের তুমি সম্বোধন, শিক্ষার্থীদের তুই-তুকারি এবং গালাগালি করা, স্বেচ্ছাচারিতা, সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে না আসা, ছুটির পূর্বেই বিদ্যালয় ত্যাগ করাসহ একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত সোমবার (০২ অক্টোবর) প্রধান শিক্ষক কর্তৃক নানা ধরণের হেনস্তার শিকার বিদ্যালয়টিন তিন শিক্ষিকা শিক্ষা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা্র বরাবর  প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক মোঃ ফিরোজ আহাম্মদ বিদ্যালয়ে উপস্তিত হন সকাল ৯.৩০ / ১০.০০ এবং  দুপুর ১২ থেকে একটার মধ্যেই চলে যান। কিন্তু অন্য শিক্ষক শিক্ষিকা প্রতিকূল পরিস্থিতি কিংবা অন্য কোনো সমস্যার কারণে ৫ মিনিট দেরিতে আসলেও অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন।  ক্লাস রুটিনে তার নামে ৩ টি ক্লাশ লিপিবদ্ধ থাকলেও সারাদিনে একটি ক্লাস নিয়ে প্রতিনিয়ত তিনি তার আত্মীয় স্বজন/ লোকজন নিয়ে বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে আড্ডা দেন। মাত্র ছয় জন শিক্ষকের কেউ যদি প্রশিক্ষণ কিংবা ছুটিতে থাকেন সেক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক ক্লাস না নিয়ে অফিস কক্ষে বহিরাগতদের নিয়ে আড্ডা দেন।

জানা গেছে, মুসলিম শিক্ষিকা হয়ে বোরকা পরিধান করা ও হিজাব পরিধানে কটূক্তি করে  তিনি বলেন, বোরকা ও হিজাব পরিধানে নারীদের প্রকৃত শারীরিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। শুধু তাই নয়, শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে নারী শিক্ষিকারা চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে/ সন্তানের চিকিৎসার প্রয়োজনে / পারিবারিক প্রয়োজনে নৈমিত্তিক ছুটির জন্য আবেদন করলে তিনি অযাচিত (অশ্লীল) কথা বলেন এবং চিকিৎসা ছুটি নিতে বলে থাকেন। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার/প্রান্তিক মূল্যায়নের নিজ বিষয়ের উত্তরপত্র নিজে মূল্যায়ন না করে অন্য শিক্ষকদের  মূল্যায়নে বাধ্য করেন।

অভিযোগকারী ঐ তিন শিক্ষিকা লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন,  বিয়ের পরে শিক্ষিকারা অন্যত্র প্রেম বিনিময় করলে অসুবিধা হয়না এবং স্বামীরাও এ বিষয়ে আপত্তি করবে না বলে প্রায়শই আপত্তিকর ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করেন। প্রধান শিক্ষক মো. ফিরোজ আহাম্মদের শিক্ষক হয়েও শিক্ষিকাদের তুমি এবং শিক্ষার্থীদের তুই বলে সম্বোধন করেন। স্টাফ কাউন্সিল অথবা অন্য কোন সভায় মিলিত হলে তিনি শিক্ষিকাদের সাথে কর্কশ, রুঢ় ও বিকট শব্দে বাক্য বিনিময় করে থাকেন।

অভিযোগকারী শিক্ষিকারা জানান, প্রধান শিক্ষক মো. ফিরোজ আহাম্মদের নিয়মিত এ ধরনের আপত্তিকর আচরণে আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছি। প্রায় এক বছর ধরে এই হেনস্থার শিকার হয়ে আমরা আর সহ্য করতে না পেরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। এর আগে মৌখিক ভাবে জানালে কর্মকর্তারা লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়টির বেশ কয়েকজন অভিভাবক জানান, প্রধান শিক্ষকের অপকর্ম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই লোকটার জন্য বিদ্যালয়ের পড়াশোনা মান নিন্মগামী। শিক্ষার্থীদের সাথে তুই তুকারি করেন, কোনো শিক্ষার্থী দুষ্টামি করলে বাজে ভাষায় গালাগালি পর্যন্ত করেন। ঠিক মত স্কুলে আসেন না। ইচ্ছে মত আসেন ইচ্ছে মত চলে যান। আমরা এর প্রতিকার চাই।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক সব অভিযোগ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং ব্যক্তি আক্রোশ থেকে করা হয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, লিখিত অভিযোগকারী একজন শিক্ষিকাকে  চিঠির ভিত্তিতে প্রশিক্ষণে পাঠিয়েছিলাম কিন্তু তিনি না গিয়ে অন্য শিক্ষিকাকে পাঠিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি যখন তাদের শোকজ করি এরপর তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে। অভিযোগকারী তিন শিক্ষিকা উল্লেখ করলে তিনি জানান, অন্য শিক্ষিকা অভিযোগে স্বাক্ষর করেননি তার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তরণে তিন দিনের প্রশিক্ষণের জন্য বিদ্যালয়টির সহকারি শিক্ষিকা রিংকু রানী পালকে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে আগেই জানানো হয়। তিনি অসুস্থতা জনিত কারণে প্রশিক্ষণে যোগদান করতে না পারায় উপজেলা শিক্ষা অফিসকে জানালে বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষিকা ফাতেমা তুজ জহুরাকে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। গত দুই তারিখ বিদ্যালয়টির তিন শিক্ষিকাকে প্রধান শিক্ষকের হেনস্তার প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দেওয়ায় প্রধান শিক্ষক ফিরোজ আহম্মদ গত ৫ অক্টোবর সহকারী শিক্ষিকা রিংকু রানী পাল এবং ফাতেমা তুজ জহুরাকে শোকজ করেন অসাদাচরণ এবং চাকরিবিধির পরিপন্থি কার্যকলাপ উল্লেখ করে ১ অক্টোবর  তারিখ দেখিয়ে। প্রকৃত পক্ষে দুই তারিখের অভিযোগ থেকে বাঁচতেই প্রধান শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে শোকজ বিষয়টি সামনে আনেন। এবং শিক্ষাবার্তা’র কাছে দাবি করেন প্রশিক্ষণের বিষয়ে দুই শিক্ষিকাকে এক তারিখে শোকজ করা হয়েছে বিধায় তারা তার বিরুদ্ধে দুই তারিখে অভিযোগ এনেছেন। বাস্তবে গত ৫ অক্টোবর শোকজ নোটিশ পান ঐ দুই শিক্ষিকা এবং পাঁচ তারিখেই চিঠির রিসিভ কপিতে তারা স্বাক্ষর করেন।

বিদ্যালয়টির শিক্ষিকা রিংকু রানী পাল বলেন, প্রশিক্ষণ এবং শোকজের সাথে অভিযোগ দায়েরের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ২ অক্টোবর এবং আমাদের শোকজ করেছে পাঁচ অক্টোবর। বরং অভিযোগ দায়ের করার কারণেই আমাদের দুই শিক্ষিকাকে তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে শোকজ করা হয়। এই শোকজ করলে করতে পারে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তিনি কোন এখতিয়ারে করলেন। প্রশিক্ষণে কোনো সমস্যা হলে সেটা দেখবে শিক্ষা কর্মকর্তা। তিনি যে হেনস্থা অসাদাচরণ করেছেন সেটা থেকে বাঁচতেই এই শোকজ নাটক এবং পাঁচ তারিখে শোকজ করলেও দেখিয়েছেন এক তারিখে। আমার ২০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এরকম বাজে ভাবে কোনোদিন হেনস্তার শিকার হয়নি। আমি এর প্রতিকার চাই।

জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির শিক্ষিকা ফাতেমা তুজ জহুরা শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, প্রধান শিক্ষকের আচরণ কোনভাবেই শিক্ষকসুলভ নয়। তার হেনস্তার শিকার হয়ে এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে হয় আমাদের বদলি নিতে হবে না হলে চাকরি ছাড়তে হবে। এখানে চাকরি করার মত কোনো পরিস্থিতি নেই। প্রতিটা দিন তিনি এমন আচরণ করেন যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। প্রশিক্ষণ নিয়ে শোকজ করার বিষয়টি হচ্ছে অভিযোগ থেকে বাঁচার একটি হাতিয়ার তার। আমরা এই প্রধান শিক্ষকের হেনস্তা থেকে পরিত্রাণ চাই।

বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষিকা অজিবা খাতুন বলেন, আমি এই প্রতিষ্ঠানে যে কয় দিন ধরে আছি প্রধান শিক্ষকের হেনস্তার শিকার হচ্ছি। আমি বোরকা পড়ি এটা নিয়েও তিনি যে বাজে আচরণ-মন্তব্য করেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তার কু প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় তিনি যেভাবে পারছেন আমাকে অপমান-অপদস্থ করছেন। আপনি অভিযোগে স্বাক্ষর করেননি অপর দুই শিক্ষিকার সাথে প্রশিক্ষণ নিয়ে শোকজের কারণে তারা এই অভিযোগ দিয়েছেন প্রধান শিক্ষকের এমন মন্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, আমিই সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হয়েছি আর আমি স্বাক্ষর করব না? এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমি নিজে স্বাক্ষর করেছি। তিনি নিজেকে বাঁচাতে শোকজ নাটক, আমি স্বাক্ষর করেনি আর কত কথা বলবেন।

জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহমুদুল হাসান মোহন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি অভিযোগটি পড়েছি এবং শুনেছি তবে কেউ আমাকে কিছু জানায় নাই। তবুও আমি আগামীকাল স্কুলে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে বসব।

সুবর্ণচর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবু জাহের শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি প্রশিক্ষণে বর্তমানে চট্টগ্রামে আছি। অভিযোগের অনুলিপি পেয়েছি। যতদূর জানি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় আমাকে তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রশিক্ষণ শেষ হলে আমি বিষয়টি তদন্ত করব। তদন্তে প্রমাণিত হলেও অবশ্যই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।

এ বিষয়ে সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল আমিন সরকার শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, অভিযোগ পেয়েছি দুই পক্ষ থেকেই। প্রধান শিক্ষকও অভিযোগ দিয়ে গেছেন। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। তদন্তে প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শাহ আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, এই অভিযোগের বিষয়টি আপনারা কিভাবে পেলেন? তিন নারী শিক্ষিকা প্রধান শিক্ষক কর্তৃক হেনস্তার শিকার হয়ে অভিযোগ করলেন আমরা কিভাবে পেলাম সেটার চেয়ে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন সেটা বড় কি’না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, নাহ আপনাদের কাছে কিভাবে অভিযোগ গেল সেটা জানতে চাচ্ছি। আমরা কিভাবে পেলাম তার চেয়ে অভিযোগের বিষয়টি কিভাবে দেখছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, খতিয়ে দেখা হবে। প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/১০/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়