টাঙ্গাইলঃ জেলার গোপালপুরে এক সহকারী শিক্ষককে ৩০ দিনের মধ্যে বিয়ে না করলে চাকরিচ্যূত করার নোটিস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মূল ধারায় মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গত ২৬ জুলাই উপজেলার ধোপাকান্দি ইউনিয়নের সাজনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাকে এ নোটিশ প্রদান করেন।
জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ওই সহকারী শিক্ষক গোপালপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ নিয়ে টাঙ্গাইল জেলা মাধ্যমিক বিভাগের দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছেন।
জানা যায়, গোপালপুর পৌরশহরের পালপাড়ার বাসিন্দা রনি প্রতাপ পাল ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে সাজনপুর উচ্চবিদ্যালয়ে হিন্দু ধর্ম বিষয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এর মধ্যে স্কুল পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি সিরাজুল আলমের স্বাক্ষর জাল করে সোনালী ব্যাংক গোপালপুর শাখা থেকে বেশ কিছু টাকা উত্তোলনের পর আত্মসাৎ নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের সঙ্গে সহকর্মীদের বিরোধ তৈরি হয়। এ ছাড়াও সরকারি নিয়ম ভঙ্গ করে একক নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে স্কুলের যাবতীয় টাকা লেনদেন করায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ আনেন স্কুলের সকল শিক্ষক ও অফিস স্টাফরা। রনিপাল এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। শিক্ষকদের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে টাঙ্গাইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে এর তদন্ত চলছিল।
রনিপালের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক দুর্নীতির তদন্তের ঘটনায় তাকে তদন্ত কমিটির সামনে সাক্ষী দিতে মানা করেন। কিন্তু তিনি কথা না শোনায় প্রধান শিক্ষক ভয়ানক রুষ্ট হন। এ অবস্থায় গত ২৬ জুলাই প্রধান শিক্ষক তাকে একটি পাক্কা নোটিশ প্রদান করেন। নোটিসে বলা হয়, বিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে তিনি যেন বিবাহ কার্য সম্পন্ন করে কতৃপক্ষকে অবহিত করেন। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে চাকরিগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নোটিশ পাওয়ার পর দিন রনি প্রতাপ প্রধান শিক্ষককে লিখিতভাবে জানান, তার অভিভাবকরা তার বিয়ের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু হিন্দু বিয়েতে গোত্র বা বর্ণের বিষয় থাকায় সহজে পাত্রী মিলছে না। তাছাড়া তার ধর্মীয় রীতিতে শ্রাবণ থেকে কার্ত্তিক পর্যন্ত বিবাহ চলে না। আগামী অগ্রহায়ন মাসে তার পরিবার তাকে বিবাহ করাবেন বলে প্রধান শিক্ষককে অবহিত করানো হয়। কিন্তু প্রধান শিক্ষক রনি পালের লিখিত জবাবে সন্তষ্ট হননি। পরদিন স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে বিয়ে না করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকিধামকি দেওয়া হয়। এতে শিক্ষক রনি খুব অপমানবোধ বোধ করেন। এ অবস্থায় তিনি ঘটনাটি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকেও লিখিতভাবে জানান।
স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোশারফ হোসেন অভিযোগ করেন, রনি পাল একজন ভালো শিক্ষক। তার অবিবাহিত থাকা নিয়ে তার বিরুদ্ধে কোনো শিক্ষার্থী বা অভিভাবক কখনো অভিযোগ করেনি। প্রধান শিক্ষক শুধু মাত্র দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই রনিপালকে বিবাহ করার নামে বিপাকে ফেলেছেন। চাপে ফেলে সম্মানহানির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।
এদিকে প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতি তদন্তের জন্য গত মঙ্গলবার ২২ আগস্ট গোপালপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নাজননীন সুলতানা ওই স্কুলে যান। তদন্ত চলাকালে প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম শিক্ষক রনি পালের উপর চড়াও হন। ওই দিন রাতে তিনি প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে গোপালপুর থানায় লিখিত অভিযোগে দায়ের করেন। অভিযোগে তিনি জানান, প্রধান শিক্ষক বিয়ের নোটিস দেওয়ার পর এবার তার প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন। তিনি খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক। যে কোনো সময় তার ওপর হামলা হতে পারে। তাই জীবন নিয়ে শঙ্কাবোধ করছেন।
গোপালপুর থানার ওসি মোশারফ হোসেন জানান, ওই শিক্ষক প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এটির তদন্ত চলছে। তার নিরাপত্তার বিষয়টি পুলিশ দেখভাল করবে।
গোপালপুর উপজেলা শিক্ষক সমিতির সম্পাদক শফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম একজন দুর্নীতিপরায়ন লোক। শিক্ষক হিসাবে নিজের মর্যাদা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। তার আচরণ ও স্বভাব নিয়ে শিক্ষক সমাজ খুবই লজ্জিত।
স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক জোয়াহের আলী জানান, তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ দুব্যর্বহারের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। একজন শিক্ষককে এভাবে নোটিস করা কোনো সজ্জন লোকের কাজ হতে পারে না।
প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ব্যাকডেটের চেক দিয়ে ব্যাংক থেকে স্কুলের টাকা তোলা অনুচিৎ হয়েছে। আর সহকারী শিক্ষক রনি পালকে নোটিস করেছেন অনেকটা না বুঝে। ছোটখাটো ভুলত্রুটি তিনি করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে বসে মিটমাট করার চিন্তা করছেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নাজনীন সুলতানা জানান, টাঙ্গাইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস নতুন করে বৃহস্পতিবার তিন সদস্য বিশিষ্ট আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। এ নিয়ে দুটি কমিটি গঠন করা হলো। পরের কমিটি শুধু বিবাহ নোটিস নিয়ে তদন্ত করবেন। তিনি এ কমিটির সদস্য সচিব। আর সদস্য হলেন টাঙ্গাইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের দুই কর্মকর্তা যথাক্রমে বায়েজিদ হোসেন ও আসাদুজ্জামান মিয়া। আগামী রোববার নতুন কমিটি স্কুলে সরেজমিন তদন্ত করতে যাবেন। তিনি আরও জানান, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগটি প্রাথমিকভাবে সত্য মনে হয়েছে। আর এভাবে কোনো সহকারী শিক্ষককে কোনো প্রধান শিক্ষক নোটিস দিতে পারেন না।
অপরদিকে দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ এবং শিষ্টাচার বহিভূর্ত আচরণের অভিযোগে প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামকে বরখাস্তের দাবিতে গত বুধবার ২৩ আগস্ট সাজনপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গনে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক জোয়াহের আলী বিএসসি। বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গোপালপুর উপজেলা শাখার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম তালুকদার, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সালেহ উদ্দীন লিটন, নুরুল ইসলাম, সরকার মাসুক মৃদুল, এমএ গনিসহ অনেকে।
বক্তারা দুর্নীতি পরায়ন প্রধান শিক্ষককে বরখাস্তের দাবি জানান। মতামত জানার জন্য স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি স্থানীয় সংসদ সদস্য ছোট মনিরকে মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৫/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়