নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ যশোর বিমানবন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (সমাজবিজ্ঞান) শফিকুজ্জামান আদতে একজন বিমানের টিকিট কর্মী হলেও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে বেকডেটে নিয়োগ নিয়ে কোনো যোগ্যতা না থাকলেও শিক্ষক হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার, অসৎ আচরণ ও অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে সাময়িক বরখাস্ত থাকলেও আবার পুনরায় স্বপদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বিদ্যালয়টির শিক্ষক কর্মচারী ও অভিভাবকদের মধ্যে। ক্ষমতার অপব্যবহার, অসৎ আচরণ ও অসদুপায় অবলম্বন ও নিয়োগ জালিয়াতির অভিযোগে বিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা কমিটি সাময়িক বরখাস্ত করলে সেই মেয়াদ শেষে তিনি পুনরায় বিদ্যালয়ে ফিরেছেন।
শিক্ষাবার্তা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর বিদ্যালয়টিতে এমপিওভুক্ত না হওয়ার শর্তে খন্ডকালীন নিয়োগ পান যশোর বিমানবন্ধরের টিকিট কর্মী হিসেবে কর্মরত শফিকুজ্জামান। যশোর বিমান বন্দর কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়টিতে খন্ডকালীন নিয়োগের ক্ষেত্রে বিমানবন্দরে কর্মচারী হিসেবে চাকরির সুবাদে কিছু কর্মকর্তার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে এই নিয়োগ বাগিয়ে নেন তিনি। শিক্ষকের কাম্য যোগ্যতা না থাকলেও তিনি খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকেন। এমপিওভুক্ত না হবার শর্তে খন্ডকালীণ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেও ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে দেখা যায় তিনি এমপিওভুক্ত হয়েছেন (সমাজবিজ্ঞান) সহকারী শিক্ষক হিসেবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবরের পরে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। শূন্যপদে শিক্ষক প্রয়োজন হলে এনটিআরসিএতে চাহিদা পাঠাতে হবে এনটিআরসিএ শূন্যপদের বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগ দেবে। তবে ২২ অক্টোবরের আগে যদি কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় সেক্ষেত্রে ২২ অক্টোবরের পরে এই নিয়োগ দেওয়া যাবে।
এমপিওভুক্তিতে তিনি যে কাগজপত্র সাবমিট করেছেন সেখানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের ২রা অক্টোবর শুক্রবার জাতীয় দৈনিক অগ্নিশিখা পত্রিকার মূল সংখ্যায় এবং স্থানীয় দৈনিক সমাজের কাগজ পত্রিকায় যশোর বিমান বন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। প্রকৃত পক্ষে ২০১৫ সালের ২রা অক্টোবর শুক্রবার প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক অগ্নিশিখা পত্রিকার মূল সংখ্যায় যশোর বিমান বন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। ওই একই তারিখে স্থানীয় দৈনিক সমাজের কাগজ পত্রিকা পাবলিস্টই হয়নি। অথচ ওই সমাজের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন বলে শফিকুজ্জামানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে দৈনিক সমাজের কাগজের সম্পাদক সোহরাব হোসেন এর আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দৈনিক সমাজের কাগজ পত্রিকা কোনো শুক্রবারেই বের হয় না। তাহলে এই পত্রিকার ২০১৫ সালের ২রা অক্টোবর রোজ শুক্রবারের সংখ্যায় কীভাবে যশোর বিমানবন্দর স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো তা সম্পাদক হিসেবে আমার জানা নেই।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) ২০০৫ সালে গঠনের পর থেকে ২২ অক্টোবর ২০১৫ সাল পর্যন্ত ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে যে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেখানে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। অথচ শিক্ষক শফিকুজ্জামানের এনটিআরসিএর কোনো সনদ নেই।
সম্প্রতি ব্যাকডেটে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ ঠেকাতে উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির আবেদনের তথ্যের সঙ্গে ব্যানবেইস সংরক্ষিত শিক্ষক-কর্মচারীদের তথ্য যাচাই করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর শিক্ষকদের তথ্য হালনাগাদ করে। যে সালেই শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয় সে বছরই বেনবেইসে সেই শিক্ষক-কর্মচারীর তথ্য আপডেট থাকে। অর্থ্যাৎ কোনো শিক্ষক যদি ২০১৫ সালে নিয়োগ পান তাহলে ২০১৫ সাল অথবা ২০১৬ সালে বেনবেইসে সেই শিক্ষকের তথ্য অবশ্যই হালনাগাদ থাকবে। যদি তা না থাকে তাহলে সেটা বেকডেটে নিয়োগ যা জালিয়াতি করে করা হয়েছে।
বেনবেইসে শিক্ষক শফিকুজ্জামানের তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, তার প্রথম যোগদান দেখানো হয়েছে ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর অথচ তার তথ্য আপডেট করা হয়েছে ২০২০ সালে। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বেনবেইসে এই শিক্ষকের কোনো তথ্য নেই যা বেকডেটে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া।
বিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া বর্তমান প্রধান শিক্ষক ২০১৯ সালে যোগদান করেই শিক্ষক শফিকুজ্জামানকে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে নিয়োগ দেন অতি গোপনে। তিনি নিজেই একজন জালিয়াতি করে নিয়োগ পাওয়া প্রধান শিক্ষক। নিয়োগ পেয়ে জালিয়াতি করবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি শফিকুজ্জামানকে বেকডেটে নিয়োগ দেখিয়ে এমপিওভুক্ত করেছেন।
জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার, জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সাথে অসৎ আচরণ, শিক্ষার্থীদের সাথে বাজে ব্যবহার ও অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে সহকারী শিক্ষক শফিকুজ্জামানকে পাঠদানসহ বিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল ম্যানেজিং কমিটি। একাধিক অভিযোগ যশোর শিক্ষাবোর্ড আমলে নিয়ে তাকে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি (টিআর) থেকেও অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি আশিকুর রহমানের ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠানটিতে এহেন কোনো অপকর্ম নেই যা এই শিক্ষক করছন না। আশিকুর রহমানের ভয়ে শফিকুজ্জামানের অত্যাচার নিরবে সহ্য করছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি আশিকুর রহমান যখন ইচ্ছে প্রতিষ্ঠানে আসেন এবং ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। পর্যাপ্ত একাডেমিক জ্ঞান না থাকলেও কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধির ক্লাস নেওয়া অন্য শিক্ষকদের দেখা ছাড়া কিছু বলার সাহস নেই। অভিভাবক প্রতিনিধির ক্লাস নেওয়ার কোনো এখতিয়ার না থাকলেও তিনি প্রধান শিক্ষকের ছত্রছায়ায় নিয়মিত ক্লাস নিয়ে যাচ্ছেন। যেসব শিক্ষার্থীরা তার ক্লাস নেওয়ার প্রতিবাদ করেন তাদেরকে তিনি টিসি দেওয়ার হুমকি দেন এমনকি গালাগালিসহ গায়ে হাত পর্যন্ত তোলেন।
প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক-কর্মচারী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষক শফিকুজ্জামান বরখাস্থ হবার আগে কখনই বিদ্যালয়ে সঠিক সময়ে আসেননি। প্রায় জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সাথে বাজে ভাষায় গালিগালাজ, মারতে যাওয়া সহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। এরকম শিক্ষক স্কুলে থাকলে স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ আর থাকবে না।
তবে তার এই নিয়োগ জালিয়াতি ও অসাদাচরণ নিয়ে যশোর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, যশোর শিক্ষা বোর্ড ও মাউশিতে অভিযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত করা হয়নি।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মনোজ কুমারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর শিক্ষা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মাহফুজুল হোসেন মিটিংয়ে আছে পরে এই বিষয়ে কথা বলবেন বলে জানান। তবে এরপর মুঠোফোনে কল করলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোঃ আহসান হাবীব শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি যশোরের বাহিরে আছি। এই মহুর্তে বলতে পারছি না। বোর্ডে গিয়ে অভিযোগের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন জানান, অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে অচিরেই তদন্ত করা হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৮/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়