প্রকল্পের অর্থ ছাড় হলেও শিক্ষক কর্মচারীর বেতন বকেয়া

যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি

যশোরঃ দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি গ্রহণ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রত্যেক জেলা থেকে প্রথম সারির একটি এনজিও নির্বাচন করা হয়। যশোরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা। দুটি এরিয়ায় বিভক্ত করে ছয়টি উপজেলা ও যশোর পৌরসভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের টাকা এনজিও কর্তৃপক্ষ তুলে নিলেও জরিপকারীদের টাকা, উপজেলা ম্যানেজার, শিক্ষক ও সুপারভাইজার বেতন-ভাতা পরিশোধ করেনি। স্কুল কেন্দ্রের ভাড়াও রয়েছে বকেয়া।

অভিযোগকারী যশোর সদর উপজেলার ম্যানেজার মো. আব্দুল্লাহর দাবি, কার্যক্রম শুরুর আগে ঝরে পড়া শিশুদের তথ্য সংগ্রহে জরিপকারীদের ৮০ ভাগ টাকা এখনো বকেয়া। শিক্ষক ও সুপারভাইজার নিয়োগে অর্থ বাণিজ্য হয়েছে। চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকল্প শেষ হলেও শিক্ষক ও সুপারভাইজারদের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলের জন্য ভাড়া নেয়া ঘরের টাকা পাননি বাড়ি মালিকরা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দের তুলনায় নিম্নমানের পোশাক ও ব্যাগ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তাদের নিজেদের তৈরি করা। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেয়া হয়েছে; সেটিও নিজেরা তৈরি করেছে। ব্যাংক থেকে স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করলেই তা ধরা পড়ে যাবে। এসব বিষয় তুলে ধরে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ করেছেন তিনি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালককে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমার দুই মাসের বেতন এবং এক বছরের টিএ বিল পাওনা রয়েছে। আমি একা নই, প্রত্যেক শিক্ষক, সুপারভাইজার, ম্যানেজারের বেতন বকেয়া। ভাড়া পাননি বাড়ির মালিকরা। কিন্তু কাগজপত্র জালিয়াতি করে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা ওইসব টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের পোশাক ও ব্যাগ দিয়ে বরাদ্দের টাকা লুটপাট করেছে।’

যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাহিমা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘জালিয়াতি বা অনিয়ম দুর্নীতির সব অভিযোগ মিথ্যা। যারা এ প্রকল্পে কাজ করতে পারেনি তারা এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যাবতীয় হিসাব তাদের কাছে রয়েছে।’

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, যশোরের ছয়টি উপজেলার প্রায় ৪০০ স্কুল কেন্দ্রের এক বছরের ভাড়া বকেয়া রয়েছে। দেড় হাজার টাকা হিসেবে ৪০০ স্কুলের এক বছরের ভাড়া ৭২ লাখ টাকা। আর যশোর পৌরসভার ৬০টি কেন্দ্রে আড়াই হাজার টাকা করে দেড় বছরের ভাড়া দেয়া হয়নি। যার পরিমাণ ৩০ লাখ টাকা। যদিও ভাড়া বাবদ বরাদ্দের টাকা দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছে। এছাড়া যশোর পৌরসভার ৬০টি স্কুল কেন্দ্রের ৬০ শিক্ষকের ১০ হাজার টাকা করে দুই মাসের বেতন বাবদ ১২ লাখ টাকা, ছয় উপজেলার ৪০০ শিক্ষকের ৫ হাজার টাকা করে দুই মাসে ৪০ লাখ, ৫০ জন সুপারভাইজারের ১৫ হাজার টাকা করে দুই মাসের বেতন ১৫ লাখ, পৌরসভার ছয়জন সুপারভাইজার ও উপজেলার আটজন ম্যানেজারের ২০ হাজার টাকা করে দুই মাসে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রের জন্য মোসলেম বিশ্বাসের ঘর ভাড়া নেয়া হয়। অথচ একদিনের ভাড়াও পাননি তিনি। ওই কেন্দ্রের শিক্ষক মোসলেম বিশ্বাসের পুত্রবধূ মোছা. জুইনা খাতুন বলেন, ‘কেন্দ্রে প্রথম যে শিক্ষক ছিলেন, বেতন না পেয়ে তিনি চার-পাঁচ মাস পর চলে যান। এরপর আমি শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেছি। পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও বেতন পায়নি।’

একই উপজেলার ধর্মগাতি কেন্দ্রটি ওই গ্রামের জহুরুল ইসলামের বাড়িতে। জহুরুল ইসলামের ছেলে মাজহারুল ইসলাম জানান, তারাও কেন্দ্রের কোনো ভাড়া পাননি। তার স্ত্রী ঝরনা খাতুন ওই কেন্দ্রের শিক্ষক। তিনিও কোনো বেতন-ভাতা পাননি। বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক জেসমিন খাতুনের আট মাসের বেতন বকেয়া। কেন্দ্রের বাড়ির মালিক নাজিম মেম্বারও পাননি ভাড়া। একই উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়নের বেতালপাড়া কেন্দ্রের বাড়ির মালিক মোক্তার হোসেনও ভাড়া পাননি।

ওই ইউনিয়নের সুপারভাইজার আব্দুর রহিম বলেন, ‘এ ইউনিয়নের কোনো কেন্দ্রের বাড়ির মালিক ভাড়া পাননি। কিন্তু দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থা টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। আমার বেতন এবং সোশ্যাল বেনিফিটের টাকাও বকেয়া।’

সার্বিক বিষয়ে যশোর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস  বলেন, ‘অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো তাকে চিঠি দিয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলেছে। চাহিদা অনুযায়ী আমি কাগজপত্র ও প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।’

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৫/১০/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়