সুমাইয়া আকতার: জ্ঞানের পরিসর বাড়াতে বই পড়ার গুরুত্ব আমরা সবাই জানি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবন জীবিকায় বই পড়াকে কতটা পাঠ্য অভ্যাসে পরিণত করতে পেরেছি সেটা প্রশ্ন হিসেবে থেকে যাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রগতিশীলতার সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক বিকাশ। জীবনে সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে পড়তে হবে বই, গড়ে তুলতে হবে বইয়ের সাথে বন্ধুত্ব।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় হাতে হাতে সবার স্মার্টফোন, ট্যাব ইত্যাদি আসায় মানুষ নিজস্ব সত্তা থেকে বেরিয়ে আসছে। অবসর সময় গুলো কাটছে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সামাজিক মাধ্যম গুলোতে। ফলে পাঠ্যবিমুখতা সৃষ্টি হয়েছে গত কয়েক দশক ধরেই। লাইব্রেরিগুলো জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। থেমে গেছে পছন্দের বই খোঁজার হিড়িক। মানবজীবনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যেন শুধুমাত্রই একটি সরকারি চাকরি প্রাপ্তি। যে কারণে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি লাভের আশায় পড়াশোনা করা ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
কিন্তু মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘শিক্ষা জীবিকা উপার্জনের পথ বলে ধরে নেওয়া আমার সামান্য বুদ্ধিতে নিচু বৃত্তি বলে বোধ হয়। মানুষের সৃজনশীলতা বিকাশ, জ্ঞানার্জন, গবেষণা, সাহিত্যচর্চার মত বিষয়গুলি হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। যে কারনে অন্যান্য দেশগুলির মত আমাদের দেশেও খ্যাতিমান সাহিত্যিক, লেখক, দার্শনিক, গবেষক তৈরি হচ্ছে না। অথচ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য মনুষ্যত্বের বিকাশ করা, চাকরি বা শুধু জ্ঞানার্জন নয়।
শৈশব থেকেই শিক্ষার মানে একটা ভুল বার্তা দিয়ে স্কুলে পাঠানো হয়েছে আমাদের। ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে’। তাই জিপিএ-ফাইভ পাবার জন্য সবাই পড়াশোনা করছে। কোচিং, স্কুলে ছুটছে। শিশুরা পড়া তৈরি করছে অবসাদ, বিরক্তি জোর জবরদস্তি সহকারে।
যা নিয়ে বই পড়া প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘সেখানে ছেলেদের বিদ্যে গেলানো হয়, তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক। এর ফলে ছেলেরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে।’ পড়ার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে, সেই আনন্দকে আমরা ভয় ও বিতৃষ্ণায় পরিণত করে ফেলেছি। ফলস্বরূপ একবার যে ছেলেটি বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোয়, পড়ার সঙ্গে তার সব সম্পর্ক তখনই চুকে যায়।
এ জন্যই বোধ করি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমনি করিয়া কোনোমতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু মনের বিকাশ হয় না। শিক্ষকেরাও সিলেবাসের নির্দিষ্ট গুটি কতেক বিষয়ের বাইরেও যে জ্ঞানের বিশাল জগৎ রয়েছে, তার সন্ধান দিতে পারেন না বা দেন না।’
শুধুমাত্র পেটের দায়ে শিক্ষিত হওয়াই প্রকৃত শিক্ষা নয়। বরং শিক্ষা হলো স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। তাই বই পড়ার বিকল্প কিছু নেই।
মানব জীবনে বইয়ের গুরুত্বের কথা স্মরণ করে টলস্টয় বলেছেন, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই। বই নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা, পছন্দের তালিকার বেশ কিছু বই থেকে একটি বই চয়েজ করা, এতেও মানুষের মেধার বিকাশ ঘটে। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই এই সময় খরচ করতে চায় না। তাছাড়া অনেকেই চাহিদা অনুযায়ী তার কাঙ্খিত বিষয়টিকে সাজানো গোছানো পেতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফলে বইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জ্ঞান আহরণ প্রতি বেশ অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু যে বই পড়াকে বন্ধু হিসেবে যে নিতে পেরেছে সে বই পড়ার আনন্দ পেয়েছে।
কারণ, অনেক পাঠকই বই পড়তে গিয়ে নিজের দিকেও ঠিকমতো মনোযোগ দেওয়ার সময় পায়না। বহু ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ একবার স্কুলে পড়ার সময় লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ায় এমন মনোযোগী ছিলেন কখন যে দপ্তরি দরজা বন্ধ করে চলে গেছে সেটা টেরও পাননি। পরে দপ্তরিকে ডেকে বিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে বের হন।
আমাদের পরিবারগুলোতেও নেই নিয়মিত পড়ার চর্চা।বেশ কিছু অভিভাবকরা যারা পড়ালেখার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন, তারাও শিক্ষায়তনিক পড়া বা সিলেবাসের বাইরের পড়াকে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর মনে করেন। তারাও এক পর্যায়ে পছন্দের বই পড়াতে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। এজন্য দেখা যায় ক্ষুধা নিবারণের তাগিদে আমরা হয়ে পড়ি ব্যস্ত। যেখানে মনেরও যে ক্ষুধা কিংবা তৃষ্ণা রয়েছে সেসবের খোঁজ রাখা হয়না।
মানবিক বিকাশ, নীতি-নৈতিকতার ভূমিকা, বিবেক-বিচেনার পরিধিগুলো কেবলমাত্র বই আমাদের শেখাতে পারে। সেজন্য নিয়মিত পাঠ্যাভাসে লাইব্রেরিতে যাবার কোন বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে অনেক লাইব্রেরিতে যুগোপযোগী বই সরবরাহ না থাকায় লাইব্রেরি বিমুখ হয়েছে অনেকে। সময় উপযোগী কিংবা পছন্দের তালিকায় রাখা বই ক্রয় করা যাচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমেও। অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তির যুগে যান্ত্রিক কাঠামোর গতিশীলতায় লাইব্রেরি কেন্দ্রিক পাঠ্যভাস গড়ে উঠছেনা। থাকছেনা লাইব্রেরিতেও পড়ার পরিবেশ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা। ফলে লাইব্রেরি বিমুখ হবার সংখ্যাও বাড়ছে গণহারে।
পাঠ্যবিমুখতা ও পাঠভ্যাস একদিনে তৈরি হয় না। এটা দীর্ঘ দিনব্যাপী পরিবেশের বিরূপতা, নিরুৎসাহিত, মানসিক অভ্যাসের পরিবর্তন, লাইব্রেরির অসহযোগিতা, শিক্ষার বিপরীত ভাবমূর্তি তৈরি ইত্যাদি কারণে বাড়ছে। জাতি বিনির্মাণে বই পড়া এবং বইয়ের আলোকে নিজেকে গড়া প্রতি নাগরিকের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এজন্য শুধু পাঠক বা সামাজিক পরিবর্তনই প্রয়োজনীয় নয়। প্রয়োজন পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, সমাজ, রাষ্ট্র সবার সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন। শুধুমাত্র লাইব্রেরিই পাঠ্যভ্যাস তৈরিতে ভ‚মিকা রাখতে পারবেনা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১১/০৯/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়