নিয়োগ বাণিজ্য কে করে কেন করে

ড. জেবউননেছা :

শুরুতে কয়েকটি ইতিবাচক ঘটনা। সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন পুলিশ সুপার তার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলায় ৩৩ জন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগের আগে নিয়োগ দালাল যেন কোনো রকমের দুর্নীতি করতে না পারে তার ওপর কড়া নজর রেখেছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। সেই নজরদারি থেকে পাঁচজনকে ক্লোজড এবং একজনকে বদলি করাও হয়েছে। শতভাগ স্বচ্ছ থেকে নিয়োগ দিয়েছেন এই পুলিশ সুপার। এমনকি চূড়ান্ত নিয়োগের আগে কোনো প্রার্থী তার জমি বিক্রি করছে কি-না, তাও খবর নিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশের কোনো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লেখা থাকে যে, কোনো রকমের তদবির প্রার্থীর অযোগ্যতা বলে প্রমাণিত হবে। সেই সূত্র ধরে তিনি যে কয়জন নিয়োগ দিয়েছেন, কোনো ধরনের বিতর্ক বা গুঞ্জন শোনা যায় না।

ব্যক্তিগতভাবে আমি যে কয়টি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি, আমার নিয়োগের আগে কোনো ধরনের নিয়োগ বাণিজ্য চোখে পড়েনি। এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করার আগে সরাসরি নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত এবং শিক্ষকতার জন্য বিবেচিত হয়েছিলাম।

এ তো গেল ইতিবাচক কিছু ঘটনার কথা। নেতিবাচক ঘটনাও সমাজে ঘটছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান মেধা সারিতে পিছিয়ে থাকা প্রার্থীকে চাকরি দেওয়ার নজির রয়েছে। এ ছাড়া কোনো কোনো জেলায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ বাণিজ্যের খবরও শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদের চাকরির জন্য ১৮ লাখ টাকা লেনদেনের ব্যাপারে একটি অডিও জনসমক্ষে এসেছে। যতদূর জানি, বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। যেমন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ কমিটি। সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, নিয়োগ কমিটি বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

একটি দেশ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় জনগণের কল্যাণের জন্য। সেই রাষ্ট্রের গুটিকতক মানুষ যখন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তখন কিছু করার থাকে না। ধরা যাক সেই সৎ পুলিশ সুপারের কথা, তিনি যদি শতভাগ সৎ থেকে কনস্টেবল নিয়োগ দিতে পারেন, তাহলে সমাজের অন্যান্য সেক্টরে এবং গোটা পুলিশ বিভাগে কেন নয়। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লিখতে পারে, তদবির প্রার্থীর অযোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। তাহলে অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কেন নয়?

প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এসব নিয়োগ বাণিজ্য নামক অপরাধ কে করে? কেন করে? কয়েকটি কারণে এই অপরাধ সংঘটিত হতে পারে, যেমন- সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম মনে করেন, অপরাধ একটি সামাজিক ঘটনা। এটি সমাজ ব্যবস্থার একটি `স্বাভাবিক` রূপ। যদিও সমাজভেদে তা স্বল্প বা তীব্র মাত্রার হয়ে থাকে। তিনি মনে করেন, সমাজে টিকে থাকার জন্য অপরাধের আশ্রয় নিতে হয়। এটা সমাজ কাঠামোর দুর্বলতার ফল। সমাজবিজ্ঞানী পার্ক ও বার্জেস স্কুল মতবাদের আলোচনায় দেখান যে, সমাজে বিদ্যমান দলগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বিচ্যুত আচরণের জন্ম দেয়। সমাজে সফলতা অর্জন করা আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও বাস্তবে ততটা নয়। ফলে সমাজের অনুমোদিত নিয়মের বাইরে অনেকেই নানা অসমর্থিত আচরণের মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করে থাকে। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানী রেইস, টবি, রেকলেস প্রমুখ মনে করেন, অপরাধ হচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে সামাজিকীকরণের ফলাফল। সমাজবিজ্ঞানীদের এই আলোচনায় বুঝতে বাকি নেই, সমাজে কেন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তারা সব ধরনের অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে। তারা শ্রেণিকক্ষে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের পক্ষে। নিজেরা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য তারা নিরাপদ চাকরির পক্ষে। সম্প্রতি লোকপ্রশাসন বিভাগকে কলেজে অন্তর্ভর্ুক্তিকরণের বিষয় নিয়ে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে নিজে যা উপলব্ধি করেছি তা হলো, সরকারি বা বেসরকারি কোনো কলেজে শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেলেই তারা সন্তুষ্ট। এসব তরুণের রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। এসব তরুণ নয়ন বন্ড বা রিফাত ফরাজী হয়ে জন্ম নেয় না। সমাজকাঠামোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতাশালীরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রিফাত বা নয়নদের জন্ম দেয়।

কয়দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছিলাম, একদিন এই দেশ সৎ এবং নীতিবানদের দখলে যাবে, সেই দিন বেশি দূরে নয়। একজন শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মন্তব্য বক্সে লিখেছে, `৩০০ জন রাজনীতিবিদ নীতিবান হলে সবকিছুই নীতিবান হবে। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি।` এই শিক্ষার্থীর কথাটি ভেবে দেখার সময় এখনই।

সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সংকট, দারিদ্র্য, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, গতানুগতিক আমলাতন্ত্রের চর্চা, দুর্নীতির প্রসার, নেতৃত্বের সংকট, নাগরিক অসচেতনতা, কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা কাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাবে বিভিন্ন অপরাধের বিস্তার ঘটে। আর এসব সমস্যার উত্তরণে সর্বস্তরে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি, শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, স্বশাসিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, উগ্রবাদের বিস্তার রোধ, গণমুখী সেবা উদ্ভাবন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা, আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চিতকরণ, যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের মাধ্যমেই একদিন এই বাংলাদেশ হবে স্বপ্নের সোনার বাংলা।

সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
asiranjar@yahoo.com