শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, বর্তমান উপাধ্যক্ষসহ ৪৪ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্ত প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে আসে। ডিআইএ পরিদর্শক এনামুল হকের নেতৃত্বে একটি কমিটি এই তদন্তকাজ সম্পন্ন করে।
অনিয়মের বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে অবৈধভাবে পদ দখল করে রাখা, ভুয়া পদ সৃষ্টির মাধ্যমে বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) নিবন্ধন সনদ না থাকা এবং জাল সনদের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ ও প্যাটার্ন (অনুমোদিত পদ) বহির্ভূত শিক্ষক নিয়োগ।
ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগে বিপুল অঙ্কের নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে। এ ছাড়া প্যাটার্নবহির্ভূতভাবে খণ্ডকালীন শিক্ষক-কর্মচারীর নামে প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মানহীন শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রয়োজনের তুলনায় কর্মচারী বেশি থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
শিক্ষকরা বলছেন, এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা না নিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের মুখে পড়বে।
বর্তমান অধ্যক্ষ মো. আজহারুল ইসলামবলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে এসব অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান গভর্নিং বডির সঙ্গে আলোচনা করে আমরা এসব বিষয়ে রেগুলেশন তৈরি করেছি। সেখানে অনিয়মের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। কারো অনিয়মের দায় আমরা নেব না।’
উপাধ্যক্ষের পকেটে চার কোটি টাকা
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান উপাধ্যক্ষ এ বি এম বেলাল হোসেন ভূঁঞা অবৈধ পদবি ব্যবহার করে অতিরিক্ত চার কোটি পাঁচ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৭
টাকা উত্তোলন করেছেন। ২০১০ সালে সহকারী অধ্যাপক থাকাকালে তিনি অবৈধভাবে উপাধ্যক্ষ-২ পদে যোগদান করেন। অথচ জনবল কাঠামো অনুযায়ী, এক শিফটের ডিগ্রি কলেজে একজন উপাধ্যক্ষের পদ রয়েছে। এ ছাড়া একজন শিক্ষক একাধিক আর্থিক লাভজনক পদে থাকতে পারবেন না।
অথচ বেলাল হোসেন উপাধ্যক্ষ-২ পদে যোগদানের পর সহকারী অধ্যাপকের পদ থেকে তাঁর অব্যাহতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং তিনি পাওনার অতিরিক্ত অর্থ তুলে নিয়েছেন। ২০২২ সালে তিনি উপাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হয়েছেন। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অবৈধভাবে উপাধ্যক্ষ-২ পদের বিপরীতে তিনি এমপিওসহ বেতন-ভাতার তিন কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার ৮২ টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে তুলেছেন। বাসাভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বাবদ প্রাপ্য অর্থের চেয়ে অতিরিক্ত ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৫ টাকা তুলে নিয়েছেন।
বেলাল হোসেন ১৯৯১ সালে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং পদোন্নতির মাধ্যমে ২০১৪ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন।
এ বিষয়ে জানতে উপাধ্যক্ষ বেলাল হোসেনকে তাঁর মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাবেক অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন গ্র্যাচুইটির নামে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া মামলার ব্যয় দেখিয়ে অবৈধভাবে তুলেছেন চার লাখ টাকা। অধ্যক্ষ পদে বহাল থাকার জন্য ২০১৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো চাকরির মেয়াদ পুনর্বৃদ্ধি করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিপন্থী হওয়ায় এই নিয়োগ বাতিলের আদেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে মামলা করে তা পরিচালনায় অবৈধভাবে টাকা উত্তোলন করেন মো. রুহুল আমিন। পরে তিনি মামলায় হেরে যান। অবৈধভাবে পদ ব্যবহার করার সময় তিনি নিয়ম ভেঙে গ্র্যাচুইটির টাকাও আত্মসাৎ করেন।
নিয়োগ রেগুলেশন টেম্পারিংয়ের (কারসাজি) মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ আলমগীর। এই নিয়োগের মধ্যমে সরকারি অংশের (এমপিও) বেতন-ভাতা আট লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা অনৈতিকভাবে উত্তোলন করেন তিনি। নিয়োগ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী প্রার্থীকে বাদ দিয়ে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী মোহাম্মদ আলমগীরকে অনৈতিকভাবে নিয়োগ দেন সাবেক অধ্যক্ষ রুহুল আমিন। গভর্নিং বডির রেগুলেশন টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে ২০০১ সালে এই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়।
নিবন্ধন সনদ ছাড়া ১০ প্রভাষক
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ প্রদত্ত শিক্ষক নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক হলেও এই সনদ ছাড়াই ১০ জন প্রভাষককে বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কর্মরত এসব শিক্ষক হলেন মোহাম্মদ রেজাউল করিম, লুত্ফুন নাহার জলি, ফারিয়াল রহমান, ইয়াসমিন আক্তার, ওমর ফারুক রকি, হালিমা আক্তার, নূর এ জাহান, ফাতেমা পারভীন, সাইফুল ইসলাম ও রেজাউল করিম।
প্যাটার্নবহির্ভূত দুই প্রভাষক
কলেজ স্তরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও জীববিজ্ঞান বিষয়ে প্রভাষক নিয়োগের অনুমতি থাকলেও ডিগ্রি স্তরে অনুমোদন ছিল না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ডিগ্রি স্তরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও জীববিজ্ঞান বিষয়ে দুজন প্রভাষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ ২৬ শিক্ষক
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বিধি অনুসরণ ছাড়াই খণ্ডকালীন ও প্যাটার্ন অতিরিক্ত হিসেবে ২৬ শিক্ষক-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন প্রভাষক তাসনিম আফরোজ, জোবায়ের হোসেন, মাহমুদা আক্তার মুনমুন, দিলরুবা আফসানা, সুবক্তগীন আরেফিন, তুহিন হাসান, বাংলা প্রভাষক নুসরাত নওরীন শীলা, কম্পিউটার সায়েন্স প্রভাষক রাবেয়া বেগম ও রাকিব হাসান, রসায়ন প্রভাষক মো. রেদওয়ান আহম্মেদ, যুক্তিবিদ্যা প্রভাষক জাহাঙ্গীর খান, ইসলামের ইতিহাস প্রভাষক ওমর শরীফ সিফাত, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রভাষক নিলুফা ইয়াসমিন ও জয় সরকার, অর্থনীতি প্রভাষক নুসরাত বিনতে নূর, গণিত প্রভাষক হযরত আলী রুমি ও সাইফুল ইসলাম, বিবিএ প্রফেশনাল প্রভাষক মো. দানিয়াল ও শামীমা ইয়াসমিন। অন্যান্য পদের মধ্যে ইমাম জাহিদুল ইসলাম, অফিস সহকারী গীতিয়ারা সাদিয়া আহসান, ইয়াসিন হৃদয় ও দেলোয়ার হোসেন, লাইব্রেরিয়ান সুপারভাইজার সঞ্জুময় চাকমা, ইলেকট্রিক্যাল পদে জাকির হোসেন এবং চালক পদে আমজাদ হোসেন।
জাল সনদে দুই শিক্ষক
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটিতে দুজন শিক্ষক জাল সনদের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। কর্মরত এসব শিক্ষকের মধ্যে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে কম্পিউটার সনদ দিয়ে ২০১০ সালে কম্পিউটার প্রভাষক পদে যোগদান করেন তুষার কণা পোদ্দার। ২০১৮ সালে এমপিওভুক্ত হন তিনি। তদন্তে দেখা যায়, ২০১০ সালে কম্পিউটার সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটির নাম উল্লেখ নেই। অর্থাৎ জাল সনদে নিয়োগ পাওয়ার মাধ্যমে তিনি অনৈতিকভাবে এমপিও অংশের ১১ লাখ ৬২ হাজার ৮০০ টাকা উত্তোলন করেছেন। এ ছাড়া পরিসংখ্যান বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের দেওয়া এনটিআরসিএর নিবন্ধন সনদ যাচাই করে দেখা যায়, তিনি জাল সনদ দিয়ে কর্মরত।
আবার যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১১ সালে সহকারী গ্রন্থাগারিক পদে রাশিদা সুলতানাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সহকারী গ্রন্থাগারিক পদের এই নিয়োগসহ অবৈধ সব নিয়োগ বাতিল করে নতুন নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে অনৈতিকভাবে নিয়োগ দেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অবৈধভাবে উত্তোলন করা অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার জন্যও বলা হয়েছে। সূত্রঃ কালের কন্ঠ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৫/০৯/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়