আয়শা খাতুন :
কোভিড-১৯, বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশে বাধ্যতামূলকভাবে লকডাউন আরোপ করেছে, সেই সাথে পরিবর্তন করেছে আমাদের কাজের ক্ষেত্র ও পরিসরের| দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন নিজ গৃহসহ কাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের আবির্ভাব ঘটিয়েছে| ফলশ্রুতিতে, ঘরে বসেই সকল দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে সবাইকে| এমতাবস্থায় গৃহ পরিচালনা করে দায়িত্বশীল ব্যক্তিটির (মা,বোন, স্ত্রী,গৃহপরিচারিকা, গৃহকর্ত্রীর) দায়িত্ব ও শ্রম বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা শ্রেয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মহিলা, স্ত্রীলোক, পত্নী, জায়ারা “Caregiver” হিসেবে বিবেচিত হয় সুতরাং ক্ষেত্রবিশেষে ও সুযোগের আবির্ভাব ঘটলে ই দায়িত্ব যেমন তাদের বৃদ্ধি পায় তেমনি অবহেলা-বঞ্চনা, নির্যাতন আর সহিংসতাও এই নারী জাতির ললাটে নির্ধারিত হয়ে যায় অতি সহজেই। হোক সে সুশীল গৃহিণী বা হোক কর্মজীবী অদম্য নারী যেখানে নারীর অবস্থান দায় বদ্ধতা সকল ক্ষেত্রেই যেন তার একটু বেশিই।
কিছু বাস্তব ঘটনার আলোকে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখা যাকঃ
শান্তা চৌধুরি পেশায় একজন চিকিৎসক। তিন সন্তানের জননী। লকডাউনের বছরখানেক আগে স্বামীকে হারিয়েছেন, তার সংসারের একমাত্র তিনিই উপার্জনকারী ব্যক্তি।বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারিবিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন। প্রয়োজনের তাগিদে যেভাবে হোক নিজের চাকরি টা ধরে রাখতে হবে এখন তাকে। মহামারী কালীন লকডাউন এর ফলে ইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে বাইরের ডাক্তারদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে, চিকিৎসাবিদ স্বল্পতার দরুন তাকে করতে হয়েছে অতিরিক্তত ডিউটি। প্রায়ঃশই টানা ১০থেকে১২ঘন্টার ডিউটি পালন করতে হয়েছে। ঘরে ফিরে দেখা মিলতো ক্ষুধার্ত তিন শিশু সন্তানের, করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়ের ফেরার পথে। জাপটে ধরে আদর করতে পারেনা আট-দশটি সাধারণ মায়ের মতন। যেহেতু তিনি একজন চিকিৎসক সুতরাং এই মরণঘাতী ভাইরাসের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য পরিপক্ক ভাবেই জানা আছে তার।নিজেকে ভালোমতো জীবাণুমুক্ত করে ঢুকে পড়েন রন্ধনশালায়।রান্না শেষ করে, ধোয়ামোছা উপরন্তু বাচ্চাদের অনলাইন পড়াশোনার তদারকি সকল কিছু তার একার হাতে সামাল দিয়ে, ফোনালাপেের মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনদের চিকিৎসা প্রদান করে হাসিমুখে বিগত এক বছর যাবত সংগ্রাম করে চলেছে কখনো অদম্য সেনানীর মতন আবার কখনো সুশীল শান্ত গৃহিণীর মতন।
স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তো হরদমে দেখা মেলে নারীদের মূল্যায়ন পুরুষের তুলনায় কম হয়়, তাদেরকে কম দক্ষতা সম্পন্ন ভেবে নিম্নবেতনে নিয়োগ করা হয় এবং এটি শিক্ষিত সমাজ থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, সকলের ক্ষেত্রে একইভাবে দেখা যায়। পারিসা ইসলাম একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকার দায়িত্বে নিযুক্ত আছেন। রুটিনমাফিক অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন, ওয়ার্কশীট রেডি করছেন বাচ্চাদের জন্য, বাড়ির কাজ পর্যবেক্ষণ এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে দিনে ৬ থেকে৭ ঘন্টা শ্রম দিয়েছেন, উপরন্ত অনলাইন ক্লাস নতুন হওয়াতে কিছুক্ষণ পর পর ফোনে যুক্ত থাকতে হয়়, উপরি মহলের নির্দেশনা শোনা এবং বোঝার জন্য। কিন্তু মাস শেষে বেতন আসছে না আগের মত কোন কিছু বলার উপায় নাই পাছে চাকরি টা আবার না চলে যায়। এর সাথে তো রয়েছে গৃহকর্তা এবং সংসারের দায়িত্ব, যিনি নিজেও বাসায় বসে অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কিছু সময় পর পর কফির আবদার, ৬ বছরের ছেলের পড়াশোনাতে সাহায্য, তিন বেলা খাবারের পরিকল্পনা, পরিবেশনা সহ সকল দিকে সমানতালে, হাঁপিয়ে ওঠার বালাই নেই তার। এর মাঝে সকল দায়িত্ব শেষে পড়ন্ত বিকেলে স্বামী-সন্তানকে নিয়ম করে জিজ্ঞেস করতে তিনি ভুলেন না “বিকালের নাস্তার মেনু তে কি চাই তাদের”এক ক্লান্তিহীন যোদ্ধা!
বুলবুলি খালা ষাটোর্ধ্ব একজন গৃহপরিচারিকা, তিনটি বাসায় ছুটা কাজ করতেন তিনি। আবাসন ছিল মিরপুর ভোলার বস্তিতে এক বৃদ্ধ অক্ষম স্বামীকে নিয়ে তার যতনের সংসার। লকডাউন এর ফলে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হওয়ার বদৌলতে দুটি বাসা থেকে কর্মবিরতি পেয়েছে। কাজেই বর্তমান চাকরিটি ধরে রাখার তার সহস্রাধিক সংগ্রাম। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে গোসল সম্পন্ন করে, নিজেকে গৃহকর্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক জীবাণু মুক্তকরণ করে, সকল রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে চাকরি ধরে রাখার আত্মপ্রত্যয় চলতে থাকে তার দীর্ঘ নয় মাস জুড়ে।লকডাউন সময়টিতে বিরামহীন পরিশ্রমের পারিশ্রমিক দিয়ে দুটো মাস্ক কিনে হাসিমুখে স্বামীকে পড়িয়ে দিয়ে বলে “গরিবের করোনা ধরে না হেডা বড়লোকের হয়, তুমি চিন্তা কইরো না আমি আছি না”। কি সাংঘাতিক মনোবল ও আত্মপ্রত্যয়ী ষাটোর্ধ্ব এই নারী সেনানী!
শেফালী আক্তার পেশায় একজন রন্ধনশিল্পী, নিজস্ব দুটি খাবারের হোটেল আছে ঢাকা শহরে। খুব ছোট পরিসরে ঘরোয়াভাবে তিনি তার ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে গুলোর জনপ্রিয়তা মাথাচাড়া দিয়ে এগুচ্ছিল। কিন্তু মহামারীর অভিশাপে ব্যবসায় ভাটা নেমে এলো। তারপর মাসের-পর-মাস হোটেলের ভাড়া গুনতে হচ্ছিল সুতরাং বেঁচে থাকার তাগিদে হোটেল বন্ধ থাকার দরুন বাড়ি থেকেই তিনি অনলাইনে ক্যাটারিং সার্ভিস চালু করলেন। নিজ হাতে বাজার করা থেকে শুরু করে, প্রস্তুতকরণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ডেলিভারি, মনিটরিং সকল দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর ছিল। পাশাপাশি বাড়িতে অসুস্থ স্বামী এবং বৃদ্ধ মায়ের দায়িত্ব তাদের সেবা, চতুর্দিকে সমানতালে চলছিলেন, তবুও ক্লান্তি নেই। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো জীবনের জোয়ার ভাটা নিয়ে প্রবাহমান ছিলেন তিনি। সব কিছু সামাল দিয়ে গোধূলি লগ্নে শ্বশুরবাড়িতে দূর দেশে থাকা তার প্রিয় মেয়েটিকে আবেগী কন্ঠে প্রশ্ন মাতার ‘মা তোর কিছু লাগবে নাকি” কি অপার শক্তি রয়েছে মমতাময়ী মায়ের মাঝে। নারী শক্তি এভাবেই অটুট থাকুক প্রতিটি ঘরে ঘরে।
একটি নতুন প্রাণ ধরণীর বুকে আনার সমস্ত প্রক্রিয়া ও তার পার্শ্ব প্রক্রিয়া সহজ, প্রসববেদনা সহ্য করার মতো অন্তঃশক্তি ও ক্ষমতা যে নারীর মাঝে রয়েছে সেই নারী আবার বহিঃশক্তি তারা প্রতিনিয়ত অপদস্থ হচ্ছেন ঘরে-বাইরে, অফিসে, কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরে।বারবার অনাদৃত উপেক্ষিত এবং লাঞ্ছিত হতে হয় তাকে। ইতিহাস বলে দিচ্ছে প্রতিটি দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং যুদ্ধকালীন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তগুলোতে নারীরাই বেশিরভাগ সময় সহিংসতার শিকার হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় “বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ” একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিভাবে তারা নরপশুদের লালসার শিকার হয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগের সাক্ষীতে মহিমান্বিত হয়ে আছে ইতিহাসের পাতা। করোনাকালীন ও তার পরবর্তী কাল এর বিকল্প নয়। নারীদের প্রতি ঘরোয়া সহিংসতা ও নির্যাতন, শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। লকডাউন এর প্রভাবে গৃহবন্দি কিছু মানুষের মস্তিষ্কে বিকৃত ঘটেছে যার ফলশ্রুতিতে ধর্ষণের মত জঘন্য ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটছে। দেখা যাচ্ছে স্ত্রীদের, কাজের মেয়েদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, কোথাও মানসিক নির্যাতন, কোথাও আবার বিকৃত যৌন নির্যাতন। অর্থনৈতিক মন্দাব্স্থার ফলেে, দরিদ্র পরিবারের কিশোরী মেয়েটিকে একপ্রকার বোঝায় পরিণত হয়েছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে বাল্যবিবাহ, লেখাপড়া বন্ধ করে আর্থিক সঙ্কট উপশমের বিকল্প হিসেবে গৃহপরিচারিকা হিসেবে নিয়োজিত হচ্ছে অনেক কিশোরী এবং কন্যা সন্তান। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের মানসিক মনোোবল আর মুক্ত আকাশে নিজেকে বিকশিত করার স্বপ্ন। যুগের পর যুগ এমন ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে আসছে, যেখানে দেশ পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব, শিক্ষকতা, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, গৃহকর্ত্রী-গৃহকর্মী সকল ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে (পুরুষের চাইতে কোন অংশে কম নয় তাদের অবদান) নিজ দায়িত্ব পালন করে আসছে এই নারীশক্তি।
আজ ৮ই মার্চ “আন্তর্জাতিক নারী দিবস”, জানাই বিশ্বের সকল নারী শক্তি এবং নারী সেনানী সেনানীদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে অভিবাদন ও অভিনন্দন। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে না পারি, তাদের এই প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ ও আত্মত্যাগের বিনিময়েে। অন্তত তাদের প্রাপ্যটুকু তাদের বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি, ধিক্কার ও লাঞ্ছনাা পরিহার করে সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধটুকু জানাই যাতে করে তারা তাদের মনোবল, আত্মসম্মানবোধ ও প্রাণশক্তিকে অটুট রেখে সামনের পথগুলো পাড়ি দিতে পারে আমাদেরই কল্যাণে।
লেখক: আয়শা খাতুন, এম.ফিল গবেষক (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় )