নতুন শিক্ষা পদ্ধতি কতটা সময়োপযোগী!

মাহমুদুল হক আনসারী: দেশে বিদ্যমান শিক্ষা সিলেবাস ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যথেষ্ট অভিযোগ আছে। প্রাইমারি থেকে হাই স্কুল পর্যন্ত, ইবতেদায়ী থেকে দাখিল পর্যন্ত যেভাবে শিক্ষা সিলেবাস ও পরীক্ষা পদ্ধতি রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে স্বয়ং শিক্ষক সমাজও সন্তুষ্ট নয়। কয়েক বছর ধরে এসব শিক্ষা পদ্ধতিতে যেভাবে সিলেবাসে পাঠদান পরীক্ষা পদ্ধতি সময়ে সময়ে পরিবর্ধন, পরিবর্তন ও বাতিল করা হয়, তাতে গোটা শিক্ষাপদ্ধতির ওপর চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। কয়েক বছর ধরে স্কুল-মাদরাসার এসএসসি ও দাখিল পর্যায়ের বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান প্রভৃতি বইয়ের মিল একরকম। স্কুলে যা পড়ানো হয়, মাদরাসা শিক্ষার সিলেবাসেও তা-ই পড়ানো হচ্ছে। পাঠদান, সিলেবাস, পরীক্ষা পদ্ধতি সবকিছুর ক্ষেত্রে উভয় শিক্ষায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

এসব সিলেবাস নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবক মোটেও সন্তুষ্ট নন। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা কারিকুলামে যেসব বইপুস্তক ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে, সেখানে স্বয়ং শিক্ষকমণ্ডলী বলেন, ছাত্রদের পাঠদানের মতো তেমন কোনো কিছু এসব বইয়ে পাওয়া যায় না। কতগুলো ছবি, কিছু কথাবার্তা, দেশ-বিদেশের ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও ধর্মীয় ঐতহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক কিছু নিদর্শন দিয়ে বইগুলো সম্পন্ন করা হয়েছে। ক্লাস ও ছাত্রদের বাড়ির জন্য কোনো কাজ দেয়া হয় না। শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে বাসায় এসে পড়ার মতো কোনো পাঠ তাদের দেয়া হয়েছে বলে স্বীকার করে না। সারাক্ষণ ক্লাস সিক্স, সেভেন ও এইটের ছাত্রদের বলতে শোনা যায়, বইতে পড়ার মতো কিছুই নেই। সিক্স-সেভেনের অঙ্ক বইয়ে ছাত্রদের শেখানোর মতো কোনো অঙ্ক শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যায় না বলে বহু অভিযোগ আছে। এসব কারণে অভিভাকদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকমণ্ডলী নানাভাবে টেনশন করছেন। যেভাবে পর্যায়ক্রমে শিক্ষা সিলেবাস ও পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার সংকোচন করা হচ্ছে, তাতে করে শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের কী ভবিষ্যৎ তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার কারণ দেখা দিচ্ছে। সরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-মাদরাসার বর্তমান এই অবস্থা। প্রাইমারি স্কুল ও ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষার মধ্যে কিছুটা ভালো উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যায়। দেশের কয়েক হাজার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার অবস্থা প্রশংসনীয় বলা যায়। অসংখ্য প্রাইমারি স্কুল ও ক্লাসের ধারণক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী দেখা যায়। শিক্ষকদের যথেষ্ট পরিশ্রম ও নিরলসভাবে ভালোবাসা, আদর ও মায়া-মমতার মধ্য দিয়ে ওই সব কচিকাঁচার শিশুদের পাঠদান করতে দেখা যায়।

শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠদান এত সহজ কথা নয়। সেখানে অনেক স্কুলের মধ্যে দেখা যায় শিক্ষক অপ্রতুল। প্রয়োজনের চাহিদামতো অনেক স্কুল তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কতৃপক্ষের তরফ থেকে পাচ্ছে না। তবুও এসব প্রাইমারি স্কুলের সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী অত্যন্ত ধৈর্য, ত্যাগ ও ভালোবাসা দিয়ে ছোটমণিদের শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি করার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। পাশাপাশি ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোয় যদিওবা শিক্ষা কার্যক্রমের নিয়মনীতি মোতাবেক সিলেবাস প্রদান করা হয়েছে, তাদের এসব ইবতেদায়ী শাখাসমূহে ছাত্রসংখ্যা খুবই নগণ্য। স্বল্পসংখ্যক মাদরাসায় চোখে দেখার মতো ছাত্রছাত্রী থাকলেও বেশিরভাগ মাদরাসায় ছাত্রসংখ্যা খুবই নগণ্য। বহু সরকারি এমপিওভুক্ত মাদরাসায় যত শিক্ষক-কর্মচারী আছেন, সে তুলনায় শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে না। চট্টগ্রামের শহর ও গ্রামে সরকারি এমপিওভুক্ত মাদরাসা পরিদর্শন করে দেখা গেছে ক্লাসে চলাকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ৮০ শতাংশ অনুপস্থিত। বেশিরভাগ শিক্ষক হাজিরা দিয়ে প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে চলে যান। তারা প্রাইভেট কোচিং ও নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে থাকেন।

এসব বিষয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বললেও বাস্তব সমস্যার কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। চট্টগ্রামে আলিম ও ফাজিল পর্যায়ের অনেক মাদরাসা আছে, যেখানে ওইসব ক্লাসে শিক্ষার্থী পাঁচ শতাংশও উপস্থিত থাকে না। খাতায় ছাত্রদের নামতালিকা আছে। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেবে, প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় অর্থ আদায় করবে, কিন্তু ক্লাস হয় না ৯০ শতাংশ ওইসব মাদরাসা শিক্ষায়। ব্যতিক্রম স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে। সেখানে শত শত ছাত্র। হাজার হাজার শিক্ষার্থী এমপিওভুক্ত ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়মিত নিয়মিত ক্লাস করে শিক্ষাবর্ষ শেষ করে। অপরদিকে শিক্ষা অনুশীলন পাঠদান থেকে বিরত ও অনুপস্থিত দেখা যায় সিংহভাগ সরকারি এমপিওভুক্ত মাদরাসায়। এসব মাদরাসা শিক্ষার হালচাল দেখে কর্তৃপক্ষকে অভিভাবকমণ্ডলী অভিযোগ করেও কোনো সদুত্তর খুঁজে পান না।

এমনিতেই সিলেবাস শিক্ষা পদ্ধতি পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের অভিযোগের শেষ নেই। এরই মধ্যে যা আছে বইপুস্তকে সেখানেও ঠিকঠাকমতো ক্লাস হয় না। পুরোপুরি শিক্ষাপদ্ধতি যেভাবে চলতে দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় আগামীতে আমাদের সন্তানরা বইপুস্তকে পড়ার মতো ও শেখার মতো কিছুই পাবে না। যারা শিক্ষা সিলেবাস প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির সঙ্গে আছেন, আসলে তারা কী চিন্তা করে এসব সিলেবাস আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য অনুমোদন দিয়েছেনÑসে প্রশ্ন অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনের। আজকের এই সময়ে সারাদেশে স্কুল-মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের ২৩ সালের বার্ষিক শেষ সময়ের কিছু একটা পরীক্ষা নিতে স্কুল-মাদরাসায় কর্তৃপক্ষ ব্যস্ত। তারা ডিসেম্বরের আগেই নভেম্বরের মধ্যেই প্রতিটি ক্লাসের সমাপনী কার্যক্রম ও ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করতে দেখা যাচ্ছে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রদের থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলের সব পাওনা আদায় করে নিচ্ছে। পড়ালেখা যা-ই হোক না কেন শিক্ষার্থীর পোশাক, ব্যাগ, ড্রেস সবকিছু ঠিক রাখা চাই। স্কুলের যাবতীয় পাওনা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীকে পরিশোধ করতে হয়। প্রাইভেট স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে হারে ছাত্রদের কাছ থেকে কোর্স ফি, ক্লাস ফি ও সেমিস্টার আদায় করা হচ্ছে, সেটি দেখলে ও শুনলে আঁতকে উঠতে হয়। প্রাইমারি লেভেলের একজন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে মাসিক পাঁচ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক শিক্ষা ফি দিতে হয় প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোয়। এর বাইরে খাতাপত্র, বইপুস্তক, কোচিংসহ আরও বহু খরচ করতে হয় অভিভাবকদের। মনে হয়, ওইসব প্রাইভেট স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও বেতনভাতা প্রভৃতি বিষয়ে কোনো নিয়ম তাদের জন্য বেঁধে দেয়া হয়নি। শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে যোগসাজশ ও তাদের অনুমোদন নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান অনেকের মতে রমরমা শিক্ষাব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে অর্থ থাকলে ও বৈধ-অবৈধ লেনদেন জানলে সবকিছু সম্ভব। সার্টিফিকেট এখন নাগালের মধ্যেই পাওয়া যায়। অর্থ জায়গামতো দিতে পারলেই কাগজের সার্টিফিকেট হাতে চলে আসে। শিক্ষার মান, গুণ, অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন এখন সোনার হরিণ। অর্থ আছে যার, শিক্ষা তার জন্য। অর্থ দিয়ে সার্টিফিকেট ও জিপিএ ফাইভ গোল্ডেন প্লাস সহজেই পাওয়া যায়। এসব কথা এখন রিকশা ড্রাইভার থেকে শিক্ষিত জনের মুখে মুখে শুনতে পাওয়া যায়।

কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। জাতিকে যদি এগিয়ে নিতে হয় তাহলে আদর্শিক সিলেবাস, নৈতিক শিক্ষাসহ অর্থ-বাণিজ্যমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দিয়ে ছাত্রদের কী শিখাতে চায় বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রম, সেটিও জনগণের গভীর প্রশ্ন। অনুশীলন-অনুকরণ, ক্লাস ও বাস্তবসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে চায় অভিভাবকমহল। এর বাইরে অন্য কোনো চিন্তা করে শিক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়বিমুখ করে তোলার ভয়াবহ পরিণতি জাতি দেখতে চায় না। বাস্তবমুখী আদর্শিক নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজš§কে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করুন।

মুক্ত লেখক, চট্টগ্রাম

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৫/১১/২০২৩  

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়