অনিন্দ্য ইকবাল, স্বাক্ষর শতাব্দ, এম সোহেল রহমান ও মোহাম্মদ কায়কোবাদঃ ২০২৩ সালে প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তি নামে একটি নতুন পাঠ্যবিষয় যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে ডিজিটাল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে এর ওপর নির্ভরতার নিরিখে আমরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। দেশে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষক ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, পূর্ববর্তী কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের আশানুরূপ দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থতা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। এ প্রেক্ষাপটে নতুন পাঠ্যবিষয়টির পরিকল্পনা এবং নতুন প্রণীত বইটি নিয়ে আলোচনার তাগিদ বোধ করছি।
নমুনা হিসেবে আমরা মূলত সপ্তম শ্রেণির বইটিকে উদ্ধৃত করব। এর সারকথা ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের জন্যও প্রযোজ্য। নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়টি পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যে ছয়টি যোগ্যতা অর্জন করবে বলা হয়েছে (পৃ ৫৯-৬০), সেগুলো হলো– যোগাযোগ ও সহযোগিতা, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন, কম্পিউটেশনাল চিন্তন, ডিজাইন চিন্তন এবং সিস্টেম চিন্তন। অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে শেখার যে কথা বলা হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন কারিকুলামে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য উপযোগী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ব্যক্ত আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেও এ লক্ষ্য খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বইটির কনটেন্ট বা আধেয় বিন্যাস কি এই লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ?
বইটি শুরু হয়েছে সার্ভে বা জরিপের মাধ্যমে তথ্য আহরণ এবং তা উপস্থাপনের উপায় নিয়ে আলোচনা দিয়ে। এখানে গুগল ফরম বা পাওয়ারপয়েন্ট জাতীয় টুলের উল্লেখ থাকলেও তাদের ব্যবহারবিধি নিয়ে আলোচনা অনেকাংশেই অপ্রতুল। দ্বিতীয় পাঠে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ব্যবহার এবং সেই সংক্রান্ত আইনের উল্লেখ আছে। এর পরে আছে ভার্চুয়াল পরিচিতি তৈরি এবং কিশোর বাতায়ন নিয়ে আলোচনা। সাইবার অপরাধ ও সচেতনতা সম্পর্কে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আলোচনা রয়েছে চতুর্থ পাঠে। রোবট নিয়ে পঞ্চম অধ্যায়ের আলোচনায় বইয়ের একমাত্র স্যুডোকোডটি দেওয়া আছে। অথচ ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে কিছু প্রবাহ চিত্র আছে, যেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে এখানে স্যুডোকোড তৈরির বিবিধ আকর্ষণীয় উদাহরণ দেওয়া যেত। পরের পাঠ দুটিতে রয়েছে বন্ধু নেটওয়ার্কের গল্প। যার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধরনের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এবং রয়েছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবাদাতা ওয়েবসাইটের ব্যবহারের ধাপগুলোর বর্ণনা। অষ্টম পাঠে আছে যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম নিয়ে পরিচিতিমূলক ধারণা। সবশেষ পাঠে আছে আঞ্চলিক বৈচিত্র্যপত্র, যা ডিজিটাল প্রযুক্তির তুলনায় সামাজিক বিজ্ঞান বা সাহিত্যের টপিক হিসেবে অধিকতর উপযুক্ত! উল্লেখ্য, ইংরেজি বইয়ের দশম অধ্যায়ে এ বিষয়ে চমৎকার আলোচনা আছে।
প্রায় ১৫০ পৃষ্ঠার সপ্তম শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তি বইয়ে সমস্যার প্রযুক্তিগত সমাধান খোঁজার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় রয়েছে মাত্র ১৫ পৃষ্ঠাজুড়ে (পৃ ৮০-৯৫)। রূপরেখায় বিবৃত যোগ্যতাগুলোর মধ্যে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন, কম্পিউটেশনাল চিন্তন, ডিজাইন চিন্তন সম্পর্কিত কনটেন্ট সাকল্যে ওই ১৫ পৃষ্ঠাতেই। সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও যে সৃজনশীলতার কথা বলা হচ্ছে, তা শেখানোর চেষ্টাও ওই সবেধন নীলমণি ১৫ পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ। এক কথায় বলা যায়, ‘শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করা’ শেখানোর জন্য ১৩৫ পৃষ্ঠা আর ‘নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার’-এর ঘোষিত লক্ষ্যের জন্য মাত্র ১৫ পৃষ্ঠার দুর্বল আলোচনা। অর্থাৎ লক্ষ্যের ক্ষেত্রে যত উচ্চাভিলাষ, তার সঙ্গে কনটেন্টের সাযুজ্য নেই। এ ছাড়া কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, নতুন পাঠ্যক্রমে তৃতীয় শ্রেণি থেকেই কোডিং শেখানো হবে। অথচ ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ে তার কোনো প্রতিফলন নেই। এ থেকে সন্দেহ হয়, ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়টি নিয়ে লেখক, নীতিনির্ধারক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবির মধ্যে বিভ্রান্তি ও সমন্বয়হীনতা কাজ করছে কিনা? অবশ্য আমরা মনে করি, বাংলাদেশের বাস্তবতায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে প্রোগ্রামিং শেখানোর অবাস্তব চেষ্টার পরিবর্তে গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষা শেখার গুণগত মান বাড়ানো ছাত্রছাত্রীর পরবর্তী জীবনে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। কিন্তু যে কোনো নিরিখেই সপ্তম শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তি-বিষয়ক বইয়ে কোডিংয়ের আরও উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়।
অত্যন্ত অল্প সংখ্যক শিখন/অনুশীলনী উপকরণ দেওয়া নতুন কারিকুলামের বেশ কয়েকটি বিষয়ের বইয়ের বড় দুর্বলতা। গণিত বইয়ে অনুশীলনী সমস্যার সংখ্যা আগের বছরের বা অন্যান্য দেশের বইয়ের তুলনায় ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়েছে, যা আমরা বিডিনিউজে প্রকাশিত আরেকটি লেখায় আলোচনা করেছি। বাংলা বইয়ে চিঠির উদাহরণ হিসেবে ও অনুশীলনের জন্য দেওয়া হয়েছে একটি করে চিঠি। একই প্রবণতা লক্ষণীয় ডিজিটাল প্রযুক্তি বইয়ের ক্ষেত্রেও। উদাহরণস্বরূপ, সপ্তম শ্রেণির বইয়ে অ্যালগরিদম তৈরি, প্রবাহচিত্র অঙ্কন ও স্যুডোকোড লেখার একটিমাত্র অত্যন্ত দুর্বল উদাহরণ হয়েছে। এমনকি আঞ্চলিক বৈচিত্র্যপত্রের (নবম শিখন অভিজ্ঞতা) আলোচনায়ও যে যত্নের ছাপ পাওয়া যায়, অ্যালগরিদমিক চিন্তার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীকে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। এ অবহেলা বিস্ময়করই বটে! এ ছাড়া ডিজাইন চিন্তন সম্পর্কিত বিষয়গুলো, যেমন প্রাথমিক ডিজিটাল লজিক ডিজাইন (বেসিক গেট-এর মাধ্যমে সরল সার্কিট) শুরুই করা হয়নি। সুতরাং রূপরেখার শেষ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ অর্থাৎ ডিজাইন চিন্তনের সূচনা ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে হচ্ছেই না।
বইয়ের অ্যালগরিদমের একমাত্র উদাহরণটি নিচে উদ্ধৃত হলো:
১ম ধাপ। প্রথমে রোবট চালু করি; ২য় ধাপ। রোবটের ক্যামেরা দিয়ে সামনের অবস্থা দেখি; ৩য় ধাপ। যদি দেখি কোথাও আগুন দেখা যাচ্ছে না তাহলে চতুর্থ ধাপে চলে যাই। আর যদি দেখি সামনে আগুন দেখা যাচ্ছে তাহলে রোবটের পাইপ দিয়ে পানিপ্রবাহ কর, আগুন না নেভা পর্যন্ত পানি ঢালতে থাকি। ৪র্থ ধাপ। কাজ শেষ।
এখানে আগুন নেভানোর জন্য রোবটের ব্যবহারের অ্যালগরিদম হিসেবে এটি উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে এখানে বেশ কয়েকটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, এই অ্যালগরিদমটি কি আসলেই রোবটের জন্য যথাযথ হয়েছে? রোবটের সংজ্ঞায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ সম্পন্ন করা একটি প্রধান অনুষঙ্গ। অথচ এখানে যে অ্যালগরিদম দাঁড় করানো হয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীরা রোবটের ধারণাই ভুলভাবে পাবে। ফলে এর পরবর্তী অনুষঙ্গগুলোও যেমন স্যুডোকোড বা প্রবাহ চিত্র তৈরি– কোনোটাই খুব অর্থবহ হয়ে উঠবে না শিক্ষার্থীদের কাছে! বইয়ে প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট (এবং একমাত্র) স্যুডোকোডটি এমন: শুরু ক = ক্যামেরা যদি ক = হ্যাঁ হয়, আগুন নিভাই () এর পর শেষ অন্যথায় শেষ
রোবটের দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থবহতার কথা যদি বাদও দিই, এই উদাহরণ দিয়ে অ্যালগরিদম বা স্যুডোকোডের আকর্ষণ, যুক্তি প্রয়োগের সৌন্দর্য এসব কিছুই ছাত্রছাত্রী অনুভব করবে না। অথচ খুব সহজেই একটা গ্রিড এঁকে, সেখানে রোবট বসিয়ে ডান-বাম, ওপর-নিচ এমন সহজ কিছু নির্দেশ ব্যবহার করে স্যুডোকোডের কার্যকরী উদাহরণ তৈরি করা যেত। বিভিন্ন ধরনের অন্তত তিন-চারটি উদাহরণ ও চার-পাঁচটি অনুশীলনী ছাত্রছাত্রীকে বিষয়টি শেখানোর জন্য কার্যকর হতে পারত। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ফান্ডামেন্টাল বা প্রাথমিক কোর্সগুলোর জন্য জনপ্রিয় বইগুলোতে এ রকম অনেক আকর্ষণীয় ও কার্যকর উদাহরণ রয়েছে এ বিষয়গুলো শেখানোর জন্য।
তবে কি আমরা ধরে নেব যে ল্যাব ও শিক্ষক অপ্রতুলতার কথা মাথায় রেখে লেখকরা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ে প্রোগ্রামিং বা কোডিং সম্পর্কে অর্থবহ কিছু শেখানোর প্রয়াস পাননি? এটাই যদি বাংলাদেশের বাস্তবতা হয় তবে অবাস্তব রূপরেখায় আমরা মেতে আছি কেন? এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, এই পর্যায়ে প্রোগ্রামিং শেখানোর চেয়ে গণিত ও বিজ্ঞানের ভিত্তি সুদৃঢ় করার প্রয়োজন বেশি বলে অনেকেই মনে করে। সে ক্ষেত্রে রূপরেখার বক্তব্যও বাস্তবসম্মত করা প্রয়োজন। হতে পারে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ল্যাব ছাড়াই গাণিতিকভাবে বা খাতা-কলমে লজিক্যাল ও কম্পিউটেশনাল সমস্যা সমাধানের বিস্তৃত চর্চা প্রচলন করা। আর নবম-দশম শ্রেণিতে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী যোগ্যতা অর্জনের জন্য কার্যকরভাবে প্রোগ্রামিং শেখানো। আরেকটি উপায় হতে পারে দুটি ঐচ্ছিক বিষয় নবম-দশম শ্রেণিতে প্রবর্তন করা: একটি স্মার্ট কম্পিউটার ব্যবহারকারী তৈরির জন্য এবং অন্যটি প্রোগ্রামিং শেখানোসহ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মতো অগ্রসর বিষয়গুলো ধারণ করবে। যে স্কুলগুলোর পক্ষে প্রোগ্রামিং শেখানোর সক্ষমতা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না, তারা শুধু প্রথম বিষয়টিই পড়াবে। আর যেসব স্কুল দুটি বিষয় পড়াতে সক্ষম, তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে গাণিতিকভাবে লজিক্যাল ও কম্পিউটেশনাল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অষ্টম শ্রেণিতে যারা আগ্রহ ও দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে তারা দ্বিতীয়োক্ত বিষয়টি বেছে নেবে।
এ ছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন ক্লাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহের বিষয় অতিরিক্ত চর্চা করার যে প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সুবিধা পাওয়া যাবে। যেমন– কম্পিউটার ক্লাবের মাধ্যমে আগ্রহীদের প্রোগ্রামিং শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া একটি ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হতে পারে, যেখানে প্রোগ্রামিং শিক্ষকস্বল্পতা মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা পেশাজীবীরাও ক্লাবের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে শেখাতে পারবেন। এ ছাড়া ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য যদি শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাতেও প্রোগ্রামিং শেখাসহ লজিক্যাল ও কম্পিউটেশনাল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে ভালো করতে পারা মানে হলো যুগপৎ প্রোগ্রামিংয়ে এবং বিশ্লেষণাত্মক সমস্যা সমাধানে পটুত্বের পরিচয় দেওয়া, যাকে কম্পিউটেশনাল সমস্যা সমাধানের পূর্বশর্ত হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গণিত অলিম্পিয়াডের কথাও টেনে আনা যেতে পারে। কারণ, গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য চর্চা নিঃসন্দেহে বিশ্লেষণাত্মক সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ায়।
বইটির পরবর্তী বা পরিমার্জিত সংস্করণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অষ্টম-দশম শ্রেণির আসন্ন বইগুলোর জন্য এবং সার্বিকভাবে এনসিটিবির কর্মকাণ্ড আরও দায়িত্বশীলভাবে পরিচালনার জন্য আমাদের সুপারিশগুলো নিম্নরূপ:
১. প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রস্তুতি হিসেবে চতুর্থ শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন আগ্রহব্যঞ্জক সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহিত করতে হবে, যার মাধ্যমে তাদের মধ্যে অ্যালগরিদমিক চিন্তা-প্রক্রিয়া, কম্পিউটেশনাল প্রসিডিউর সম্পর্কে ধারণা ও লজিক্যাল সমস্যা পদ্ধতিগতভাবে সমাধানের দক্ষতা গড়ে উঠবে। হঠাৎ একজন শিক্ষার্থীকে এ বিষয়ে দক্ষ করে তোলা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রশিক্ষণ, যা পুরো বিষয়টি তার অভ্যাসে পরিণত করবে। তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একজন শিক্ষার্থী যে কোনো সমস্যা, যে কোনো পরিস্থিতিতে কম্পিউটেশনাল চিন্তন, গাণিতিক এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণে অভ্যস্ত এবং পারদর্শী হবে।
২. নবম-দশম শ্রেণিতে প্রোগ্রামিং শেখানো ফলপ্রসূ করতে গেলে প্রতিটি স্কুলে ল্যাব ও শিক্ষক লাগবে। ল্যাব তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে আইসিটি বিভাগের সঙ্গে। তারা ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার স্কুলে এরই মধ্যে ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০২৫ সালে বর্তমান কারিকুলামের প্রথম ব্যাচ যখন নবম শ্রেণিতে পড়বে তার আগেই অবশিষ্ট ১৫ হাজার স্কুলের ল্যাব স্থাপন সম্ভব। এ জন্য আমাদের হিসাবে ৫ হাজার কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হবে। বর্তমান ল্যাবগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, সে প্রশ্ন রয়েছে।
৩. ল্যাব নির্মাণের তুলনায় অনেক কঠিন সমস্যা হলো অন্তত ৩৫ হাজার শিক্ষক পাওয়া, যারা প্রোগ্রামিং শেখাবেন। পশ্চিমা দেশগুলোতে বিভিন্ন স্কুল তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী প্রোগ্রামিং শেখায়। অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তারা অনলাইন এডুকেশন প্ল্যাটফর্মগুলোর সাহায্য নেয়। বাংলাদেশে এমন প্ল্যাটফর্মের অপ্রতুলতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজে বা আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিতভাবে অনলাইনে প্রোগ্রামিং শেখানোর মতো কোর্স তৈরির ব্যবস্থা নিতে পারে, যা শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ছাত্রছাত্রীরা ল্যাবে অনুশীলন করবে। শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রজেক্টে বুয়েটের সিএসই বিভাগের পরামর্শে একটি স্কুল পর্যায়ের কম্পিউটার সংক্রান্ত বিষয় শেখানোর জন্য অ্যাপ্লিকেশন ও কনটেন্ট তৈরির কম্পোনেন্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অবশ্য বিষয়টির অগ্রগতি আমাদের জানা নেই। ভবিষ্যতে কারিকুলামের সঙ্গে সংগতি রেখে এ ধরনের কোর্স তৈরি করে ছাত্রছাত্রীর জন্য বিনামূল্যে সরবরাহ করা যেতে পারে।
৪. যেহেতু ডিজিটাল প্রযুক্তি বা এর অন্তর্গত পাঠ্যক্রম বিষয়ে বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাংলাভাষীদের মধ্যে অপ্রতুল; এর লেখক নির্বাচনে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। বর্তমান লেখকদের সদিচ্ছা, নামমাত্র সম্মানীতে প্রচণ্ড পরিশ্রম ও প্রয়াসের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায়, এ ধরনের কাজে যে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে দেশের শ্রেষ্ঠ অপশনগুলো নেওয়া হয়নি। লেখক নির্বাচন উন্নত করার জন্য জন্য নিচের প্রস্তাবগুলো রাখা হলো:
(ক) সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে সিনিয়র বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে বিভিন্ন শ্রেণির জন্য আলাদা লেখক দল নির্বাচন। এ মানদণ্ডের বিবেচ্য বিষয় হতে পারে যে কোনো পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের টেক্সট বই লেখার অভিজ্ঞতা, বাংলায় মানসম্মত টেক্সট বই লেখার অভিজ্ঞতা, রিসার্চ পেপারের ভাষাগত শৈলী, বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলা লেখার নিদর্শন ইত্যাদি।
(খ) বিভিন্ন সময়-জোন ও স্থান থেকে নির্বাচন করলে, অন্য পূর্ণকালীন পেশায় নিযুক্ত থাকলে লেখকদের টিমওয়ার্ক বাধাপ্রাপ্ত হয়। সে বিবেচনায় নির্বাচিত কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগকে একেকটি ক্লাসের বই লেখার দায়িত্ব দেওয়া। তারা প্রয়োজনমতো তাদের পূর্ণকালীন লেখক নিয়োগ করবে। এনসিটিবি জোগাবে স্কুল-কলেজের শিক্ষক (যারা শ্রেণির জন্য বইয়ের উপযোগিতা দেখবেন), পেডাগজিস্ট, ভাষা বিশেষজ্ঞ প্রমুখ।
যে কোনো পদ্ধতিতেই নিশ্চিত করতে হবে লেখক-সম্পাদকরা যাতে পর্যাপ্ত সময় পান। বর্তমান লেখকদের কাছ থেকে নিদারুণ সময়স্বল্পতার কথা শোনা গেছে। পর্যাপ্ত পূর্ণকালীন সহযোগী লেখক, গ্রাফিক্স ডিজাইনার/ অলংকরণশিল্পী, সম্পূরক ইলেক্ট্রনিক ম্যাটেরিয়াল তৈরির বিশেষজ্ঞ, প্রুফরিডার, ভাষা সম্পাদক প্রভৃতি নিয়োগ করার মতো অর্থের সংকুলান থাকতে হবে। যে পাঠ্যবই ১০ বছরে প্রায় ২ কোটি ছাত্রছাত্রী পড়বে; যার কাগজ, ছাপা, বিতরণ ও অন্যান্য লজিস্টিক খাতে খরচ হবে ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা, সেই বইটি প্রকাশনার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন লেখকদের যে সম্মানী বর্তমানে দেওয়া হয়, তাতে তাদের পর্যাপ্ত সময় ও বইয়ের উন্নতমান আশা করা যায় না।
পরিশেষে, একটি নতুন বিষয় প্রবর্তনের পর এনসিটিবির পক্ষ থেকে এর উপযোগিতা ও কার্যকারিতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মানুষকে নিয়ে বড় পরিসরে আলোচনা, বিতর্কের আয়োজন করা প্রয়োজন। চ্যাটজিপিটির মতো জেনেরেটিভ মডেলের বিশাল সাফল্য আগামী দিনে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের কর্মীদের দক্ষতার চাহিদা বদলে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ মাহেন্দ্রক্ষণে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়টির বিন্যাস ও লক্ষ্য আরও সুবিবেচনাপ্রসূত হতে হবে। সুত্রঃ সমকা
লিখেছেনঃ অনিন্দ্য ইকবাল, অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, বুয়েট; স্বাক্ষর শতাব্দ, অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; এম সোহেল রহমান, অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, বুয়েট এবং মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/০৯/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়